বাহির পানে
দক্ষিণের টান
সৈকতে পেঙ্গুইন-রাজ
যেন উলটপুরাণ!
অন্য প্রাণীর ঘর ভাঙতে মানুষ ওস্তাদ। বসতি তৈরি, উন্নয়নের নামে জঙ্গল দখল করে কত প্রাণীকে যে মানুষ তাদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করেছে তার তালিকা বিশাল। বাসস্থান হারিয়ে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তাই অনেক প্রাণীই মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। মানুষের বসতির ধারেকাছে নিজের ঘর বানায় না।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের কাছে বোল্ডার্স সৈকতে গেলে এ ধারণা পাল্টে যাবে। এ সমুদ্রতট একেবারে লোকালয়ের গায়ে। মানুষের সঙ্গে পেঙ্গুইনদের এমন সহাবস্থান পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে না। বালিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে পেঙ্গুইনের দল। জল থেকে উঠে দু’টি হাত (ফ্লিপার) দিয়ে গা পরিষ্কার করছে কেউ। কেউ বা বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। কেউ ভর দুপুরে সমুদ্রতটে হেঁটে খিদে বাড়িয়ে নিচ্ছে। তার পরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলে। ডুবসাঁতার দিয়ে চলে যাচ্ছে চোখের আড়ালে। ভুস করে উঠে আসছে মুখে মাছ নিয়ে। মায়েদের সঙ্গে বাচ্চারাও সমান তালে শিকার ধরছে।
ওই পেঙ্গুইনদের থেকে আমাদের দূরত্ব কত হবে? বড়জোর এক মিটার। হাত বাড়ালেই পেঙ্গুইনের স্পর্শ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এমনটা কেউ করে না। আর করে না বলেই এখানে পেঙ্গুইনেরা অনেক বেশি নিরাপদ। এমন উলটপুরাণ হল কী ভাবে? এলাকার বহু দিনের বাসিন্দা মৎস্য ব্যবসায়ী স্টিভ জোনসের কথায়: “এখানে আমরা পেঙ্গুইনের এলাকা দখল করিনি। পেঙ্গুইনরাই উল্টে আমাদের সরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে ওরা। ওদের জন্য আমরা সমুদ্রতট ছেড়ে যাচ্ছি।
সাঁতার কাটার জন্য নতুন নতুন এলাকা খুঁজতে হচ্ছে। আশ্চর্যের ঘটনা নয় কি?”
কেপটাউনে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যটন দফতরের দেওয়া তথ্য বলছে, কাছে সিমন্সটাউনে মানুষের বাস বহু দিনের। এ চত্বরে আগে কোনও পেঙ্গুইন ছিল না। ১৯৮২-তে কোথা থেকে এক জোড়া পেঙ্গুইন দলছুট হয়ে এসে পড়েছিল বোল্ডার্স সৈকতে। ওই দু’জন স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেল এই এলাকার। ১৯৮৫ থেকে ওরা বংশবিস্তার শুরু করল। ৩১ বছরের মধ্যে একেবারে কাছ থেকে পেঙ্গুইন দেখার অন্যতম আকর্ষণীয় এলাকা হয়ে উঠল দক্ষিণ আফ্রিকার এই এলাকা। বোল্ডার্স বিচ এলাকায় বিশাল ভিলা রয়েছে স্টিভ জোনসের।
এই এলাকার বাসিন্দা হিসেবে গর্ববোধ করেন তিনি। তাঁর মন্তব্য, “মানুষের সঙ্গে পেঙ্গুইনের এই সহাবস্থান পাওয়া যাবে না বিশ্বের আর কোথাও। আসলে এখানে আমরা পেঙ্গুইনের ঘরবাড়ি ভাঙিনি। ওরাই সাঁতরে
এসে জুড়ে বসেছে আমাদের এই সমুদ্রতটে। ওরাই দখল করে নিয়েছে সমুদ্রতটের অধিকাংশ এলাকা। বালিতে দিব্য ডিম পাড়ছে। তা ফুটে বাচ্চা হচ্ছে। ৩১ বছরে পেঙ্গুইনের সংখ্যা দুই থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০০।”
কেন এই সমুদ্রতট পেঙ্গুইনদের ভালো লেগে গেল? স্টিভের ধারণা, “এই এলাকায় অগভীর সমুদ্রে ছড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল গ্রানাইটের বোল্ডার। সেই বোল্ডারের ফাঁকফোকরে লুকিয়ে হাঙর আর ছোট তিমির হাত থেকে নিজেদের বাঁচায় বিভিন্ন ধরনের মাছ।
বোল্ডার ঠেলে তীরের কাছে অগভীর জলে হাঙর বা ছোট তিমি শিকার ধরতে আসতে পারে না। বোল্ডারের বাধার জন্যই মৎস্যজীবীদের পক্ষে অতলান্তিকের এই এলাকা অনুকূল নয়। তাই বোধ হয় পেঙ্গুইনেরা এখানে বেশি নিরাপদ বোধ করে।”
সমুদ্র থেকে বেশ কিছুটা দূরে বালির মধ্যে দেখলাম আড়াআড়ি পোঁতা আছে কাটা বোতল। আর সেই বোতলের পাশে ঝোপের ধারে বসে আছে এক জোড়া পেঙ্গুইন। আমাদের পিছনে এসে কখন যে দাঁড়িয়েছেন আমাদের গাইড আবদুল লতিফ তা বুঝতে পারিনি। আবদুল বললেন, “ওই কাটা বোতলের মধ্যে সদ্যোজাত শাবকেরা আশ্রয় নেয়। এই বোতল ওদের নিরাপত্তা দেয়।” আবদুলের মুখেই শুনলাম, কেপটাউনের এই আফ্রিকান পেঙ্গুইন মে মাসে ডিম পাড়ে। একটি স্ত্রী পেঙ্গুইন একসঙ্গে দু’টি ডিম পাড়ে। তাই অন্য পেঙ্গুইনের থেকে আফ্রিকার এই পেঙ্গুইনের বংশবিস্তার হয় দ্রুত।
গ্রাফিক্স: প্রবাল ধর
মেরু প্রদেশের যে বিশাল পেঙ্গুইন আমরা টিভিতে দেখতে অভ্যস্ত সেগুলির সঙ্গে কেপটাউনের পেঙ্গুইনের অমিলই বেশি। ছোটখাটো চেহারার এই পেঙ্গুইনের নাম
ব্ল্যাক ফুটেড পেঙ্গুইন। কারণ, এদের পায়ের পাতা কালো। পূর্ণবয়স্ক পেঙ্গুইনগুলির উচ্চতা হয় ৬০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার। ওজন দুই থেকে সাড়ে তিন কেজি। এদের গড় আয়ু ১৮ থেকে ২০ বছর। তবে আফ্রিকান পেঙ্গুইনকে ২৭ বছর পর্যন্তও বেঁচে থাকতে দেখা গিয়েছে, জানালেন আবদুল। আফ্রিকার গরমে কী ভাবে বেঁচে থাকে এই খুদে পেঙ্গুইনেরা? জোনস বলে না দিলে পেঙ্গুইনদের শারীরবৃত্তীয় একটি কৌশল আমাদের কাছে
রহস্যই থেকে যেত। জোনসের কথা মতো খুব কাছ থেকে কয়েকটি পেঙ্গুইনকে নজর করে দেখলাম ওদের চোখের উপরে গোলাপি রঙের একটা আস্তরণ। জোনস বললেন, “ওটার নাম পিঙ্ক গ্ল্যান্ড।
ওই গ্ল্যান্ডটিই তাপমাত্রা বাড়া কমার সঙ্গে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ওই পিঙ্ক গ্ল্যান্ডে অতিরিক্ত রক্ত পাঠিয়ে দেয় পেঙ্গুইনের শরীর। সরাসরি সামুদ্রিক হাওয়ার সংস্পর্শে ওই রক্ত কিছুটা ঠাণ্ডা হয়। তাতে দেহের তাপমাত্রা কমে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।”
আফ্রিকার এই পেঙ্গুইনদের জীবনচক্র বুঝতে যাতে কারও কোনও অসুবিধা না হয় তার জন্য বেশ কয়েকটি বোর্ড দেওয়া আছে সমুদ্রতটে। সেরকমই একটি বোর্ডের ছবি তুলছি, হঠাৎ গাধার ডাকের মতো একটা আওয়াজ এল পিছন থেকে। এই তল্লাটে গাধা এল কোথা থেকে? না কি পেঙ্গুইনদের শান্তি ভঙ্গ করতে কোনও হানাদার এল? পিছনে বালির উপরে দেখি একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ পেঙ্গুইন তাড়া করেছে কয়েকটি কিশোর পুরুষ পেঙ্গুইনকে। পূর্ণবয়স্ক পুরুষটি শাসন করছে অল্পবয়সীদের। যেন বলছে, ‘তফাত যাও।’
সমুদ্রতটের এই পেঙ্গুইনদের যাঁরা দেখভাল করেন তাঁদেরই এক জন ক্যাথি আমাদের উপরে নজর রাখছিলেন। আওয়াজ শুনে যে আমরা ঘাবড়ে গিয়েছি তা বুঝতে ওঁর অসুবিধা হয়নি। আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। আফ্রিকান পেঙ্গুইন সম্পর্কে আরও একটি তথ্য জানা গেল ওই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর কাছ থেকে। তিনি বললেন, “গাধার মতো আওয়াজ করে ওরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করে। এই গাধার মতো শব্দ করে বলেই ওদের জ্যাক্কাস পেঙ্গুইন বলে।”



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.