বীরভোগ্যা বসুন্ধরা কথাটি নেহাত কথার কথা নহে। সসাগরা পৃথিবী অনেক বড় ব্যাপার, সামান্য দুই বিঘা জমি অধিকারে আনিতেও যে পাইক-বরকন্দাজের প্রয়োজন পড়ে, তাহা কলিকাতা বিলক্ষণ জানে। ঊনবিংশ শতকের কলিকাতা নহে, রীতিমত একুশ শতকের মহানগর। শর্ট স্ট্রিটে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটিল, তাহার একটি অংশই ব্যতিক্রমী দুই জনের প্রাণহানি। এইটুকু ছাড়িয়া দিলে, বাকি ঘটনা কার্যত নিত্যদিনের। শহর এবং সংলগ্ন অঞ্চলে জমির দাম সমানেই বাড়িতেছে। তাহার অধিকার লইয়া বিবাদও। সেই বিবাদ নিষ্পত্তির দুইটি পরিচিত পথ আছে। প্রথম পথটি পার্টি অফিস ঘুরিয়া যায়, দ্বিতীয় পথটি সরাসরি বাহুবলীদের দরজায় গিয়া ঠেকে। স্বভাবতই, পথ দুইটি দুই দিকে বাঁকিয়া যায় নাই রাজনীতি এবং বাহুবলের সম্পর্ক নেহাত অল্প দিনের নহে। মোট কথা, জমি সংক্রান্ত বিবাদ ফয়সলা করিবার ইহাই রাস্তা।
অবস্থা দেখিলে মনে হইতেই পারে, আইন-আদালত বলিয়া বুঝি কিছু নাই। গায়ের জোর অথবা বন্দুকের নলই যাবতীয় ক্ষমতার উৎস। এই অবস্থা এক দিনে হয় নাই, অকারণেও নহে। পশ্চিমবঙ্গে আইন এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থার কল্যাণে সম্পত্তি হস্তান্তর, এবং তাহার দখল পাওয়া, প্রায় অসম্ভব একটি কাজে পরিণত হইয়াছে। দেশের বহু রাজ্যেই এই গোত্রের সমস্যা আছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তাহা অতুলনীয় স্তরে পৌঁছাইয়াছে। এই রাজ্যে ভাড়াটিয়া আইন একটি জগদ্দলবিশেষ। সেই আইনে এক বার মামলা ঠুকিয়া দিতে পারিলে যুগের পর যুগ নিশ্চিন্ত থাকা চলে। বাদী ও বিবাদী, উভয়েই ইহলোকের মায়া কাটাইয়াছেন কিন্তু মামলা যথাপূর্বং চলিতেছে, এমন উদাহরণ নেহাত কম নাই। কোন জমি কাহার, কোন শরিকের মালিকানা কতখানি, কে কাহার সম্পত্তি ভোগদখল করিতেছে, এই প্রশ্নগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি হইবার সম্ভাবনা এই রাজ্যে নাই। যদিও বা মামলা এজলাস অবধি পৌঁছায়, উকিলদের নূতন তারিখ লইবার খেলাটি ধ্রুব। ফলে, কোনও সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা অর্ধ শতক ধরিয়াও চলিতে পারে। যাঁহাদের হাতে অত সময় নাই, তাঁহারা আর আইন আদালতের দ্বারস্থ হন না। তাঁহাদের জন্য পার্টি অফিসও আছে, থানা পুলিশ আছে, বাহুবলীরাও আছেন। স্বাভাবিক। আইনের পথ অহেতুক জটিল হইলে অন্তত কিছু লোক চোরাপথের সন্ধান করিবেই। সোনা আমদানিতে কড়াকড়ি হইলেই যেমন স্মাগলিং-এর রমরমা হয়। অতএব, বীরভোগ্যা বসুন্ধরায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে আইনি সংস্কারই একমাত্র পথ।
কর্তব্য সহজ। প্রথমত, অতীতের বোঝা ঝাড়িয়া ফেলিতে হইবে। সম্পত্তির বাজার সম্পূর্ণ বদলাইয়া গিয়াছে। সেই বাজারের উপযোগী আইন চাই। দ্বিতীয়ত, মামলার নির্দিষ্ট সময়সীমা বাঁধিয়া দিতে হইবে। মহাকালের বিচারের মুখ চাহিয়া থাকিলে চলিবে না। সম্পত্তির অধিকার প্রমাণসাপেক্ষ। কী প্রমাণ গ্রাহ্য, কোনটি নহে, তাহারও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। সরকার জানাইয়া দিক, সম্পত্তির মালিকানা প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে কোন নথিগুলি আবশ্যিক। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিবদমান দুই পক্ষই আদালতে নিজস্ব নথিপত্র জমা করুক। তাহার পর, মালিকানার বিচার করিতে আর কতই বা সময় লাগিতে পারে? কোনও পক্ষের নিকট প্রয়োজনীয় নথি না থাকিলে তাহার দুর্ভাগ্য ফয়সালা তাহার বিপক্ষেই যাইবে। কিন্তু নথির অভাব ওকালতির মারপ্যাঁচে পূরণ হইবে না। মামলায় যে পক্ষ জিতিবে, আদালতই প্রয়োজনে পুলিশের সাহায্যে তাহাকে দখল দিবে। একমাত্র এই ব্যবস্থাই সম্পত্তির দখল লওয়ার ক্ষেত্রে বাহুবলী-রাজনীতিক দুষ্টচক্র ভাঙিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা এই সংস্কার করিয়া উঠিতে পারিবেন, না কি কোনও অদৃশ্য রাজনৈতিক শৃঙ্খল তাঁহাদের বাঁধিয়া রাখিবে? |