বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তৈরি চালকহীন গাড়ি,
তবু মন গলছে না জাপানের

টোকিও থেকে ফিরে
ল্পবিজ্ঞানের গল্প থেকে এতদিনে তাকে বিটুমিনের সড়কে নামানোর প্রস্তুতি প্রায় পাকা! শুধু টাচস্ক্রিন ছোঁয়ার অপেক্ষা। তার পরেই চালকহীন সেই স্বপ্নের গাড়ি ছুটে যেতে পারে গন্তব্যে। প্রতি মুহূর্তে মালিকের খবরদারির প্রয়োজন নেই। নিজ দায়িত্বেই এ গাড়ি আপনি থামবে সিগন্যালে, প্রয়োজনে পাশ কাটিয়ে যাবে অন্য গাড়িকে।
তবু কাপ আর ঠোঁটের ফাঁকটা ঘুচছে না। এমন লা-জবাব ‘ওয়ান্ডার কার’-এর পথে স্পিড ব্রেকার হয়ে দাঁড়িয়েছে খোদ রাষ্ট্র! কোন রাষ্ট্র? না, প্রযুক্তির পীঠস্থান জাপান! আশঙ্কা, যদি যন্ত্র ফেল করে! অথবা হ্যাং করে যায় প্রসেসর! সত্যিকারের রাস্তায় মহড়া-দৌড়ের সময়েও বেমক্কা দুর্ঘটনা হলে জনরোষ তো অবধারিত। তখন দায় চাপবে সরকারেরই ওপর। সর্বোপরি, জাপানি প্রযুক্তি প্রশ্নের মুখে পড়বে বিশ্বজুড়ে। এ দিকে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে দেশের শিল্পমহল। তাদের উদ্বেগ, সরকার এই গাড়িকে ছাড়পত্র না দিলে আমেরিকা আর জার্মানি তো টেক্কা দিয়ে যাবে! ফলে এক অদ্ভুত জটে আটকে পড়েছে জাপানের স্বপ্নের গাড়ির ভবিষ্যৎ।
কেমন সেই স্বপ্নের গাড়ি? ধরুন, আপনার ছেলে জামা-জুতো পরে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি। অথচ আপনাকে অফিসের জন্য তৈরি হতে হবে, ছেলেকে স্কুলে ছেড়ে আসার সময় নেই। নিজের স্মার্টফোন থেকে প্রোগ্রাম ফিক্স করে দিলেন গাড়িতে। সে অনুযায়ী চালকহীন গাড়ি ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে ফিরে এল বাড়িতে। অফিসের জন্য আপনিও তৈরি। গাড়ি আপনাকে নিয়ে রওনা হল অফিসের পথে। স্টিয়ারিং ঘোরানোর, ক্লাচ, ব্রেক, গিয়ার বদলানোর ঝঞ্ঝাট নেই। বিকেলে আপনার ‘পড়িয়ে দেওয়া’ প্রোগ্রাম অনুযায়ী গাড়ি ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে এল। তারপর আপনাকে তুলতে চলে এল অফিসে।
গুগলের তৈরি চালকহীন গাড়ি।
স্বপ্নই মনে হচ্ছে তো? আসলে মহাব্যস্ত বিশ্বের এমন স্বপ্ন ছুঁতেই উঠেপড়ে লেগেছে বিশ্বের তাবড় গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা। মূলত জাপান, জার্মানি ও আমেরিকার সংস্থাগুলির মধ্যেও শুরু হয়েছে রীতিমতো রেসিং যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা পেরিয়ে কে আগে বাজারে এনে ফেলতে পারে চালকবিহীন গাড়ি! মার্সিডিজ, জেনারেল মোটরস, অডি, নিসান, টয়োটা, হন্ডার মতো গাড়ি কোম্পানিগুলির মধ্যে প্রায় সকলেই চালকবিহীন গাড়ির ‘প্রোটোটাইপ’ (পরীক্ষামূলক মডেল) তৈরি করেছে। গুগলও সম্প্রতি এমন একটি গাড়ি তৈরি করেছে। তবে জাপানের শিল্পমহলের দাবি, বাকি বিশ্বের থেকে এ ব্যাপারে তাঁরা অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন। বরং জাপানি সংস্থাগুলিই নিজেদের মধ্যে পাল্লা দিচ্ছে। টোকিও শহরে হন্ডার গবেষণা বিষয়ক সদর দফতরে (হন্ডা আর অ্যান্ড ডি কোম্পানি লিমিটেড) বসে সংস্থার প্রেসিডেন্ট ওসিহারু ইয়ামামোতো জানিয়ে দিলেন, স্বয়ংচালিত গাড়ি বাণিজ্যিক ভাবে বাজারে ছাড়ার জন্য তাঁরা তৈরি।
ইয়ামামোতোর কথায়, “এ ধরনের গাড়িগুলি মূলত চলে কিছু সেন্সর, রেডার, ক্যামেরা, প্রসেসর ও জিপিএস-এর ওপর নির্ভর করে। ওই সব যন্ত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে গাড়ি নিজে থেকেই তার গতিপথ নির্ধারণ করে নেয়।” দাবি, হন্ডা জাপানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে উন্নত স্বয়ংচালিত গাড়ি তৈরি করে ফেলেছে। কিছু সংস্থা যখন তাদের পরীক্ষামূলক গাড়িতে ৩৪টি সেন্সর ব্যবহার করছে, হন্ডা ব্যবহার করছে ১৬টি। প্রসেসরের আয়তন কমানোয় হন্ডার গাড়িটি অনেক হাল্কাও বটে।
মুশকিল হল, এত সব সত্ত্বেও চালকহীন গাড়িকে জাপানের রাস্তায় টেস্ট-ড্রাইভেরও অনুমতি দিচ্ছে না শিনজো আবে প্রশাসন। কিন্তু অটোমোবাইল প্রস্তুতকারকরাও ছাড়পত্র পেতে মরিয়া। এতটাই যে, জনমত গড়ে সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশলও নিতে শুরু করেছে তারা। গত মাসেই টোকিওতে হয়ে গিয়েছে বাণিজ্যমেলা। সেখানে হন্ডার চালকবিহীন গাড়িকে গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার জন্য বহু আগে থেকেই বিশেষ প্রদর্শনীর বন্দোবস্ত সারা হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ, প্রযুক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা বোঝাতে সিগন্যাল-সহ নকল রাস্তা, সেই সঙ্গে আর পাঁচটা অন্য গাড়ি, আচমকা কোনও মোটরবাইক বা পথচলতি মানুষ সামনে এসে গেলে কী ভাবে গাড়ি চকিতে ব্রেক কষবে, বা পাশ কাটাবে দুর্ঘটনাকে, তা দেখানোর বন্দোবস্ত।
ডাই চি লাইফ রিসার্চের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হিদেও কুমানোর কথায়, “প্রশাসনের বোঝা উচিত, জাপানকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথে ফেরাতে পারে প্রযুক্তির উদ্ভাবন। নইলে আমেরিকা দশ গোল দেবে। নেভাডা, ক্যালিফোর্নিয়া-সহ আমেরিকার ৩টি রাজ্য স্বয়ংচালিত গাড়ি পরীক্ষামূলক ভাবে রাস্তায় চালানোর অনুমতি দিয়েছে। তাই জাপানি গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘নিসান’ তাদের গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করে ফেলেছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। এ সব দেখে শেখা উচিত টোকিওরও।”
যদিও টোকিওয় স্বয়ংচালিত গাড়ির ছাড়পত্র পাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না জাপানের শাসক দল লিবারাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য তথা এমপি সুজুকি কিইসুকে। বক্তব্য, শিল্পমহলের দাবি বিবেচনা করছে সরকার। যাবতীয় স্পর্শকাতরতা বুঝতে সময় লাগছে। কারণ শুধু জাপানে তো নয়, এই গাড়ি রফতানি হলে অন্য দেশে কতটা সফল হবে সেটাও প্রশ্ন।
সুজুকি বাকিটা না বললেও বুঝে নেওয়া শক্ত নয়। উন্নত দেশে এই গাড়ি যদি সফল হয়ও, কলকাতার পোস্তার রাস্তায় পার্কিং করতে গেলে ইয়ামামোতোর চালকহীন গাড়ি কি হিমসিম খাবে না? প্রশ্নটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়!




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.