বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতি ফিরিবার সম্ভাবনা সুদূর হইতে আরও সুদূরে বিলীয়মান। বিরোধী দল বিএনপি ও তাহার সহযোগী জামাতে ইসলামি আবার বাহাত্তর ঘণ্টার হরতাল শুরু করিয়াছে। ইতিমধ্যেই সেই ধর্মঘট রক্তক্ষয়ী, প্রাণঘাতীও। এই আন্দোলনের লক্ষ্য: আওয়ামি লিগের সরকারকে বিরোধীদের দাবি মানিতে অর্থাৎ পদত্যাগ করিয়া একটি তদারকি সরকারের অধীনে পার্লামেন্টের আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করা। স্মরণ থাকিতে পারে, গত নির্বাচনের আগে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারও একই ভাবে ইস্তফা দিয়া তদারকি সরকারকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সঁপিয়াছিল। তাহার পরিণাম যে বেগম জিয়া বা তাঁহার দলের পক্ষেও শুভ হয় নাই, তাহা এখন ইতিহাস। তদারকি সরকারের দাবিতে অনড় থাকার রহস্য তাই উপলব্ধি করা কঠিন।
তথাপি যদি এই প্রশ্নে বিরোধীরা দাবি তোলেন, সেই দাবিতে গোটা দেশের জনজীবন অচল করিয়া রাখার কি কোনও যৌক্তিকতা আছে? একটি বিষয় স্পষ্ট আন্দোলন এ ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত নয়, সংগঠিত এবং পরিকল্পিত। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করিলেও তাহা বুঝা যায়। সরকারি সম্পত্তি যেমন পরিবহণ এবং দোকানপাট ভাঙচুর, লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি নিছক অরাজকতা ও অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই করা হয়। ইহার পিছনে জনসাধারণের ক্ষোভ-বিক্ষোভের বিশেষ ভূমিকা নাই। বিরোধী দল বিএনপি-র সহিত এ বার জামাতে ইসলামির যৌথ হরতালের পিছনেও সম্ভবত মৌলবাদের প্রত্যাঘাতের সংকেতও আছে। বিশেষ ট্রাইবুনালে বৎসরাধিক কাল ধরিয়া একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার দায়ে যাহাদের বিচার, মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ধার্য হইতেছে, তাঁহারা সকলেই জামাতে ইসলামির নেতা। উপরন্তু আদালতের এক সাম্প্রতিক রায়ের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে জামাতে ইসলামির যোগদানের সুযোগ কাড়িয়া লইয়াছে। শেষোক্ত এই সিদ্ধান্তটির খুব প্রয়োজন ছিল কি না, জনাদেশ লওয়ার অধিকার হইতে কোনও জনপ্রতিনিধিত্বের প্রার্থীকে নিবারণ করা সংগত কি না, সেই প্রশ্ন অহেতুক নয়। বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের উপর সরকার বা শাসক আওয়ামি লিগ প্রভাব বিস্তার করিতেছে এমন সংশয় ইহাতে গভীরতর হয়।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র তুলনায় নবীন। দীর্ঘদিন যাবৎ এই নবীন গণতন্ত্র দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামি লিগ ও বিএনপি-র দুই শীর্ষ নেত্রী হাসিনা ওয়াজেদ ও খালেদা জিয়ার দ্বন্দ্বে জর্জরিত হইয়া চলিয়াছে। দ্বন্দ্বটি যে সর্বদা খুব নীতিগত প্রশ্নে, এমন নয়, যদিও বেগম জিয়া নিহত জেনারেল জিয়ার বিধবা পত্নী হওয়ার সুবাদে সেনা-ছাউনির উপর নির্ভর করিয়াছেন বেশি, তুলনায় শেখ হাসিনা মুজিবকন্যা হওয়ার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করিয়াছেন বেশি। আশঙ্কা হয়, উভয় নেত্রীর দ্বন্দ্ব তথাপি মূলত অহমিকার। কেহ কাহাকেও এক ইঞ্চি জমি ছাড়িতে প্রস্তুত নহেন। রাজনীতিতে হয়তো এমন দ্বন্দ্ব অস্বাভাবিক নহে, কিন্তু দেশবাসীর মঙ্গলের স্বার্থে কিংবা কোনও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নেও দুই নেত্রীকে দেশবাসী কখনও একমত হইতে দেখে নাই। বরং যখন যে দল ক্ষমতাসীন, তখন তাহার বিরোধী পক্ষ পার্লামেন্ট বয়কট করিয়া পাঁচ বছর ধরিয়া বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির রাস্তার আন্দোলনে ব্যাপৃত থাকিয়াছে। আবার ভোটে পরাস্ত হইয়া শাসকরা বিরোধী শিবিরে স্থানান্তরিত হইলে তাহারাও পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছে। সেই ধারা অব্যাহত। মাঝখান হইতে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির এজেন্ডা ক্রমশ স্থগিত হইয়া চলিয়াছে। অহমিকার বলি হইতেছে দেশের কল্যাণ। গণতন্ত্র বিরোধী মত ও শক্তির বোঝাপড়া দাবি করে, নিরন্তর সংঘাত নয়। |