তাঁর বিদেশনীতি ভুল, এমন কথা প্রকাশ্যে বলছে না দল। তবু দলের চাপেই শেষ মুহূর্তে শ্রীলঙ্কা সফর থেকে পিছিয়ে আসতে হল প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে। কংগ্রেসের যুক্তি, ভোট এগিয়ে এলে ঘরোয়া রাজনীতির দায় বা স্বার্থ উপেক্ষা করে চলা যায় না। প্রধানমন্ত্রী কলম্বো গিয়ে রাজাপক্ষে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরির চেষ্টা চালালে সেটা দেশের তামিল আবেগকে আহত করবে। লোকসভা ভোটের মুখে সেটা ঠিক হবে না। বরং বিরোধী দলগুলি হাতে অস্ত্র পাবে এতে। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, এই বিষয়টি নিয়ে গত শুক্রবার কংগ্রেসের কোর কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই উত্তপ্ত আলোচনা হয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি বিশদে ব্যাখ্যা করেন কেন মনমোহন সিংহের কলম্বো যাওয়া উচিত নয়।
অ্যান্টনি এবং আহমেদ পটেল সেখানে এমনও বলেন যে, গত সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করাটা বিবেচকের কাজ হয়নি। প্রতিশ্রুতি রাখার কোনও লক্ষণ ইসলামাবাদের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত অসামরিক পরমাণু চুক্তি থেকে খুচরো শিল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ— বিভিন্ন বিষয়ে দলের ভিতরে ও বাইরে লড়াই করে নিজের মতকেই প্রতিষ্ঠা করে এসেছেন মনমোহন। নওয়াজের সঙ্গে বৈঠকের ক্ষেত্রেও সেটাই দেখা গিয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের শেষ বিদেশ সফরের ক্ষেত্রে পিছু হটতে হল তাঁকে। বিদেশ মন্ত্রক গোপনে সমস্ত প্রস্তুতি সেরে রাখা সত্ত্বেও।
রাজনৈতিক সূত্রের খবর, কংগ্রেসের কোর কমিটির বৈঠকে অ্যান্টনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে পাক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকটি কার্যত বিফলে গিয়েছে। গোটা দেশের জাতীয় আবেগ যখন ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে, তখন ওই বৈঠক করাটা আদৌ বিবেচকের কাজ হয়নি। ওই বৈঠকের পরেও নিয়ন্ত্রণ রেখা দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটে চলছে। বিরতি পড়েনি সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন ও হিংসার ঘটনাতেও। স্থির হয়েছিল, এ সব নিয়ে দু’দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ডিজিএমও পর্যায়ে বৈঠক হবে। আজ পর্যন্ত তা হয়নি। ফলে বিজেপি-সহ বিরোধীরা যখন ভোট প্রচারের সময় প্রশ্ন তুলবে, পাক নেতৃত্বের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করে লাভটা কী হল, তখন বিড়ম্বনায় পড়তে হবে সরকারকে।
কলম্বোও কথা রাখবে কি না, তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ আছে দিল্লির। ভারতকে কথা দেওয়া সত্ত্বেও রাজাপক্ষে সরকার এখনও তামিল জনতাকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার লক্ষ্যে সংবিধান ১৩তম সংশোধনটি করেননি। মনমোহনের কলম্বো সফরের পরে যে পরিস্থিতি বদলে যাবে, তা-ও নয়। অ্যান্টনির বক্তব্য, ডিএমকে-সহ দক্ষিণ ভারতের দলগুলির আবেগকে গুরুত্ব না দিয়ে মনমোহন শ্রীলঙ্কা সফরে গেলে, পরে একই প্রশ্ন তুলবে বিরোধী শিবির। সেটি হল, কী লাভ হল মনমোহনের কলম্বো সফরে?
প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর অ্যান্টনিই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ডিএমকে-র সঙ্গে জোট-যোগাযোগ রেখে চলছেন। ফলে দলের কোর কমিটির বৈঠকে তাঁর সরব হওয়াটা প্রত্যাশিতই। পাশাপাশি, মুখর হন সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেলও। তাঁর বক্তব্য, লোকসভা নির্বাচনের পরে সরকার গড়তে ডিএমকে-র সহযোগিতা মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে। তাদের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় তথা বিদেশ মন্ত্রকের যুক্তি ছিল, দীর্ঘ ২৪ বছর পর কমনওয়েলথ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলন হচ্ছে এশিয়ায় তথা ভারতের প্রতিবেশী একটি দেশে। শ্রীলঙ্কায় এই সম্মেলনটি করার জন্য ভারতই আগাগোড়া সওয়াল চালিয়ে গিয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের আশঙ্কা, এলটিটিই-র সঙ্গে যুদ্ধের শেষ পর্ব থেকেই পাকিস্তান এবং চিনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে কলম্বো। শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা পরিকাঠামোর উন্নয়নে বড় ভূমিকা নিচ্ছে এই দুই দেশ। এই সময়ে দিল্লি যদি রাজাপক্ষে সরকারকে নেতিবাচক বার্তা পাঠায়, সেটা আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রশ্নে ভারতকেই দুর্বল করবে। দক্ষিণ ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন, ভারতীয় মৎস্যজীবীদের ভবিষ্যৎ, দু’দেশের মধ্যে শক্তি-সহ বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তিগুলি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও কলম্বোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখাটা প্রয়োজন। কিন্তু কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা ভোটের মুখে এই সব যুক্তিতে আমল দিতে নারাজ। তবে এ নিয়ে বিতর্ক থামাতে বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ আজ জানান, বিশেষ একটি কারণে এই সফর বাতিল হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী দু’বার কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, “বারবার প্রধানমন্ত্রীকেই যেতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। তাই এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোনও জায়গা নেই।” |