পুরীতে পর্যটকদের, বিশেষ করে বাঙালিদের ভিড় যেখানে সব চেয়ে বেশি, সেই স্বর্গদ্বার ও তার আশপাশের এলাকার বাতাস অত্যন্ত দূষিত বলে ওড়িশা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। নিছক তীর্থ বা বেড়ানোর জায়গা বলে নয়, অনেকের কাছেই পুরী স্বাস্থ্যকর স্থান। ওড়িশা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট কিন্তু পরিষ্কারই বলছে, পুরীর স্বর্গদ্বার ও তার আশপাশের এলাকা আদৌ আর স্বাস্থ্যকর নয়। বরং সেখানকার বাতাস এখন স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে উঠেছে।
বাতাসে ভাসমান কণা কমবেশি সর্বত্রই থাকে। ১০ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট কণাগুলি শ্বাসের সঙ্গে শ্বাসনালীতে ঢুকে পরে। এই কণার পরিমাণ সহনমাত্রার চেয়ে বেশি হলেই তা স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। দেখা যাচ্ছে, স্বর্গদ্বারের দুই প্রান্তের বাতাসে এই কণার পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে সওয়া তিন গুণ থেকে সাড়ে চার গুণ বেশি। বাতাসে ভাসমান আরও সূক্ষ্ম কণা শ্বাসনালী পেরিয়ে ফুসফুসের ভিতরের প্রকোষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। স্বর্গদ্বারের আশপাশের এলাকায় ২.৫ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট এই সব কণার পরিমাণ সহনমাত্রার চেয়ে অন্তত সাত গুণ বেশি।
‘ন্যাশনাল অ্যাম্বিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি’-র মাপকাঠি অনুযায়ী, ১০ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট কণা প্রতি ঘন মিটার বাতাসে ১০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত থাকলে সেটা সহনীয়। ওড়িশা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সমীক্ষা বলছে, স্বর্গদ্বারের উত্তর-পশ্চিম দিকে ওই কণা রয়েছে প্রতি ঘন মিটারে ৩২০ মাইক্রোগ্রাম। আর দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ৪৬৪ মাইক্রোগ্রাম। ২.৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়েও ছোট কণা প্রতি ঘন মিটার বাতাসে ৬০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত থাকলে তা সহনীয়। সমীক্ষায় স্বর্গদ্বার এলাকায় ওই কণা মিলেছে প্রতি ঘন মিটারে ৪৩৫ মাইক্রোগ্রাম।
পুরী শহরের জনসংখ্যা প্রায় দু’লক্ষ। এ ছাড়া, সারা বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক ও জগন্নাথ মন্দিরের দর্শনার্থীর ভিড় হয়। যার একটা বড় অংশ যান পশ্চিমবঙ্গ থেকে। পুরীর দূষণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে দিল্লিতে জাতীয় পরিবেশ আদালতে (ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল) যিনি প্রতিবিধান চেয়েছেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গেরই পরিবেশকর্মী, সুভাষ দত্ত। তাঁরই আর্জিতে জাতীয় পরিবেশ আদালত ওড়িশা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে পুরীর দূষণ নিয়ে সমীক্ষা করে রিপোর্ট দিতে বলে। সেই রিপোর্টেই স্বর্গদ্বার ও তার আশপাশের এলাকার বায়ুদূষণের কথা বলা হয়েছে।
গত ২২ অক্টোবর জাতীয় পরিবেশ আদালত পুরীর দূষণ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে সুরাহার প্রথম ধাপ হিসেবে ওড়িশার মুখ্যসচিবকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দিয়েছে। কমিটিকে পুরীর দূষণের সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করতে হবে।
ওড়িশা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট জানাচ্ছে, পুরীর সমুদ্রতট বরাবর ছোটবড় মিলিয়ে ১২৪টি হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে স্বর্গদ্বারের হোটেলগুলিতেই বাঙালি পর্যটকরা বেশি ভিড় করেন। হোটেল থেকে কিছু দূষণ হয়। তবে বায়ু দূষণের বড় কারণ স্বর্গদ্বারের পূর্ব প্রান্তে আধ একরের বেশি এলাকা জুড়ে থাকা একটি শ্মশান। এ বছর জুলাই মাসে পর্ষদের তিন সদস্যের একটি দল স্বর্গদ্বার ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘুরে দেখেন। তাঁরা জানতে পারেন, স্বর্গদ্বারে প্রতি মাসে গড়ে ১,২০০ থেকে ১,৪০০ শব দাহ করা হয়। এক-একটি শব দাহের জন্য প্রয়োজন হয় দেড় থেকে দুই কুইন্টাল কাঠ। অর্থাৎ গড়ে রোজ ৬০ থেকে ৮০ কুইন্টাল কাঠ পোড়ে স্বর্গদ্বারে। পর্ষদের বক্তব্য, “বাতাসে ভাসমান কণা ছাড়াও দেহ পোড়ানোর ধোঁয়া, কটূ গন্ধ এবং ঝুলকালি স্বর্গদ্বার ও আশপাশের এলাকার বাতাসকে দূষিত করে তুলেছে। শ্মশানের ধোঁয়া সমুদ্রের বাতাসের সঙ্গে মিশে স্বর্গদ্বারের বাড়িগুলিতে আটকে পড়ে সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে। যা ওই এলাকার বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।”
বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা পশ্চিমবঙ্গের এক বিজ্ঞানীর কথায়, “স্বর্গদ্বার এলাকায় বাতাসের দূষণ যে রকম বিপজ্জনক আকার নিয়েছে, তা মানুষের জীবন বিপন্ন করার পক্ষে যথেষ্ট। মাথায় রাখতে হবে, ওই সমীক্ষা করা হয়েছে জুলাই মাসে অর্থাৎ বর্ষাকালে। যে সময়ে বাতাসে ভাসমান কণার পরিমাণ বছরের মধ্যে সব চেয়ে কম থাকে। সন্দেহ নেই শীতকালে অবস্থা আরও শোচনীয় ওঠে সেখানে।”
বায়ুদূষণ রোধের কথা জানালেও এর প্রতিকারের বিষয়টি তেমন জোর পায়নি পর্ষদের রিপোর্টে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ তাদের রিপোর্টে শুধু বলেছে, মৃতদেহ পোড়ানোর জায়গায় হাওয়া-বাতাস চলাচলের জায়গা-সহ আচ্ছাদন করতে হবে। ধোঁয়া যাতে কোনও চিমনির মধ্যে দিয়ে অনেকটা উঁচুতে বেরোয়, তা নিশ্চিত করা দরকার।
শ্মশানে কাঠের চিতার পাশাপাশি বৈদ্যুতিক চুল্লির ব্যবস্থাও রাখা গেলে তা দূষণ কমাতে অনেকটাই কাজে আসতে পারে। দূষণ থেকে স্বর্গদ্বারকে বাঁচাতে শ্মশানটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াও হতে পারে ভাল বিকল্প। কিন্তু দু’ক্ষেত্রেই রীতি বা ঐতিহ্যের প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। |