|
|
|
|
বিপদ চিন, উত্তরবঙ্গে নয়া ঘাঁটির জমি চায় সেনা |
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
সীমান্তে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে চিন। ভারতীয় সেনার কাছে চিন ক্রমশই বড় মাথাব্যথা হয়ে উঠছে। ভারত-চিন সীমান্তের নিরিখে সিকিমের নীচেই উত্তরবঙ্গের কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ বার উত্তরবঙ্গে তাই একটি নতুন সেনা ঘাঁটি এবং একটি বায়ুসেনা ঘাঁটি তৈরির কথা ভাবছে সেনাবাহিনী। তাই শীঘ্রই রাজ্য সরকারের কাছে জমি চাইবে তারা।
সেনা সূত্রের খবর, আগামী ১৮ নভেম্বর নবান্নে সামরিক-অসামরিক সমন্বয় নিয়ে (সিভিল-মিলিটারি লিয়াজঁ) রাজ্য সরকারের সঙ্গে সেনা কর্তাদের বৈঠক রয়েছে। সেখানেই আনুষ্ঠানিক ভাবে এই প্রস্তাব রাখা হবে। খসড়া প্রস্তাবটি ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠিয়েছেন সেনা-কর্তারা। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সেনাপ্রধান বিক্রম সিংহ সারা দেশের সেনাকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠকে বসেন। সেখানেই পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েনের ব্লু-প্রিন্ট ঠিক হয়। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাহাড় সফরের সময়েই সুকনায় ৩৩ নম্বর কোরের কম্যান্ডার বিষয়টি
তাঁকে জানিয়েছিলেন।
গত বছরই পানাগড়ে সেনা ছাউনির আয়তন বাড়ানোর জন্য ১২০০ একর অতিরিক্ত জমি চেয়েছিল সেনা। সেনা সূত্রের খবর, এ বার উত্তরবঙ্গের সেনা নিরাপত্তা বাড়াতে জলপাইগুড়ির ডামডিমে ৭৫০ একর জমির উপরে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েনের জন্য একটি ঘাঁটি তৈরি করা হবে (সেনাবাহিনীর ভাষায়, অ্যাক্রিশন ফোর্স)। সগাঁওয়ে ৩৬১ একর জমির উপরে বায়ুসেনার একটি বিশেষ ঘাঁটি (কম্পোজিট অ্যাভিয়েশন বেস) তৈরি হবে। তা ছাড়া কালিম্পং সেনা ছাউনির বহর বাড়ানোর জন্যও অতিরিক্ত জমি চাইবে সেনা। পূর্বাঞ্চলের সেনা মুখপাত্র, গ্রুপ ক্যাপ্টেন তরুণকুমার সিঙ্ঘা বলেছেন, “দীর্ঘমেয়াদি রণকৌশলগত সিদ্ধান্তের অঙ্গ হিসেবেই এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে রাজ্যকে।” এ রাজ্যে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে নানা সমস্যা থাকলেও তিনি আশাবাদী যে, “দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রাজ্য সরকার নিশ্চয়ই সাহায্য করবে।” রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক ইঙ্গিত মিলেছে। বস্তুত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই একাধিক বার বলেছেন, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জমি নিতে কোনও বাধা নেই। সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, “দেশের নিরাপত্তা অন্য সব বিষয়ের থেকে আলাদা। জমি দিতে যা যা সম্ভব, সবই করা হবে।”
কেন এই তিনটি ঘাঁটি বাড়ানোর উপরে জোর দিচ্ছে সেনা?
সেনার এক মুখপাত্র জানান, চিন যদি কখনও আক্রমণ করে, সেখানে উত্তরবঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, সিকিম কিংবা তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা দিয়ে নেমে চিন যদি উত্তরবঙ্গ (শিলিগুড়ি করিডর) পর্যন্ত চলে আসে, তা হলে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। চুম্বি উপত্যকা থেকে যাতে চিনা সেনা চটজলদি না ঢুকতে পারে, সে কারণে কালিম্পং ছাউনির বহর বাড়ানো হচ্ছে। ডামডিমের নতুন ঘাঁটিতে উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মাউন্টেন ডিভিশনের সেনা মোতায়েন থাকবে। সগাঁওয়ের বিমান ঘাঁটি থেকে যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও মালবাহী বিমান ব্যবহার করার ব্যবস্থা থাকবে।
এর পাশাপাশি পানাগড় নিয়েও অনেক ভাবনাচিন্তা রয়েছে সেনার। সেনা সূত্রের খবর, ‘মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর’ নামে একটি বিশেষ বাহিনীর সদর দফতর হবে পানাগড়ে। আমেরিকা থেকে কেনা সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস বিমানের ঘাঁটিও থাকবে। গত ২৭ অগস্ট বায়ুসেনার ইস্টার্ন কম্যান্ডের প্রধান রবিকান্ত শর্মা পানাগড়ে দু’দিনের সফরে গিয়ে ঘাঁটির প্রস্তুতি দেখে এসেছেন। বায়ুসেনা কর্তাদের ব্যাখ্যা পানাগড় থেকে প্রয়োজনে সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস বিমানে বাংলাদেশ, নেপাল, মধ্য তিব্বত অঞ্চলে সহজে পৌঁছনো যায়। সেনাবাহিনীর এক কর্তা বলেন, “চিনের থেকে কোনও বিপদ এলে পাল্টা আক্রমণের জন্য পানাগড়ই হবে মূল ঘাঁটি।”
সামগ্রিক ভাবে সেনার পরিকল্পনা রয়েছে চিনের সঙ্গে ৪১০০ কিলোমিটার ব্যাপী প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) বরাবর প্রায় ৪০ হাজার অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হবে। গোটা প্রকল্পে খরচ হবে ৮১ হাজার কোটি। সেনাবাহিনীর একটি সূত্র জানাচ্ছে, চিনের বিপদের কথা বলা হলেও দীর্ঘ দিন মাউন্টেন কোর (বিশেষ বাহিনী) তৈরির অনুমতি দেয়নি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি। কিন্তু লাদাখের ডেপসাং উপত্যকায় চিনা সৈন্যের অনুপ্রবেশের পরে গত ৮ অগস্ট এই বাহিনী তৈরির অনুমতি মিলেছে।
কূটনৈতিক স্তরে ভারত আর চিনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই টানাপোড়েন চলছে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে চিন নিজেদের মানচিত্রে ঢুকিয়ে রেখেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক কোর-কম্যান্ডারকে ভিসা দিতেও অস্বীকার করেছিল তারা। তার উপরে গত বছর দুই ধরে জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দাদের ‘স্টেপল ভিসা’ (পাসপোর্টে ছাপ দেওয়ার বদলে আলাদা পাতায় ছাপ) দিচ্ছে বেজিং। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চিনের পরিকাঠামো উন্নয়ন নিয়েও উদ্বেগে রয়েছে দিল্লি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক মুখপাত্র বলেন, বেজিং থেকে লাসা রেলপথ ও নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের পর চিন ওই এলাকায় তিন সপ্তাহের মধ্যেই ৫ লক্ষ সেনা মোতায়েন করতে সক্ষম। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারত সীমান্ত সড়কগুলি নির্মাণ শুরু করলেও এখনও পরিস্থিতি ততটা উন্নত হয়নি। |
|
|
|
|
|