বিল মেটাতে না পারলেও মৃতদেহ আটকে রাখা যাবে না কোনও মতেই। স্বাস্থ্য দফতরের এই নির্দেশকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়েই বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে দেহ আটকে রাখার অভিযোগ উঠছে।
শুক্রবার আরও এক বার বিষয়টি সামনে এল পূর্ব মেদিনীপুরে পথ দুর্ঘটনায় আহত এক তরুণের কলকাতায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে।
আলিপুরের একটি হাসপাতালে ওই তরুণকে ভর্তি করেছিলেন তাঁর পরিবারের লোকেরা। তিন সপ্তাহে হাসপাতালের বিল দাঁড়িয়েছিল প্রায় সাত লক্ষ টাকা। বৃহস্পতিবার ওই তরুণের মৃত্যু হয়। কিন্তু শুক্রবার রাত পর্যন্ত পরিবারের লোকেরা মৃতদেহ ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেননি সৎকারের জন্য।
বিষয়টি জানিয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই আলিপুর থানায় একটি ডায়েরি করেছেন মৃতের আত্মীয়েরা। পাশাপাশি, ওই বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অকারণ বিল বাড়ানোর অভিযোগ জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের কাছে। বিল না মেটানোয় মৃতদেহ আটকে রাখার অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের বক্তব্য, দুর্ঘটনার জেরে মৃত্যু হলে দেহ বাড়ির লোককে কেন দেওয়া হবে? দেহ দেওয়া হবে পুলিশকে। হাসপাতালের তরফে বিষয়টি আদৌ থানায় জানানো হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে নিরুত্তর পুলিশ।
সুদীপ বেরা নামে ওই তরুণের বাবা শশাঙ্ক বেরার অভিযোগ, এ ব্যাপারে স্থানীয় ভূপতিনগর থানা কিংবা আলিপুর কোথাও থেকেই তাঁকে কিছু জানানো হয়নি।
স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে কী ভাবে দেহ আটকে রাখছে বেসরকারি হাসপাতালগুলি? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “বিষয়টি খুবই গুরুতর। কোনও ভাবেই বেসরকারি হাসপাতাল এটা করতে পারে না। আমরা তদন্ত করে কড়া ব্যবস্থা নেব।”
গত ১৭ অক্টোবর বাড়ির কাছেই একটি দুর্ঘটনায় আহত হন সুদীপ। তাঁর মলদ্বারের কাছের হাড় ভেঙে যায়। প্রতিবেশীদের অভিযোগ, তাঁকে তমলুক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে বলা হয়, পুজোর মরসুমে সব ডাক্তারই ছুটিতে। আহতকে কলকাতার কোনও বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয়। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করেছেন, অভিযোগটি ঠিক নয়। রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল বলেই কলকাতায় রেফার করা হয়েছিল।
ছেলেকে বাঁচাতে কলকাতার আলিপুরে কোঠারি মেডিক্যাল সেন্টারে ভর্তি করেন শশাঙ্কবাবু। তাঁর দাবি, চিকিৎসকেরা তাঁকে জানিয়েছিলেন মলদ্বার ছাড়া ছেলের অন্য কোথাও আঘাত ছিল না। ছোট একটি অস্ত্রোপচারেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া বিল যে এই মাত্রায় পৌঁছতে পারে, সে সম্পর্কেও তাঁদের সম্যক ধারণা ছিল না।
শশাঙ্কবাবুর প্রতিবেশী, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ মাহমুদ হোসেন বলেন, “স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীকে বেসরকারি হাসপাতালের অমানবিকতার বিষয়টি জানিয়েছি। মাথায় চোট বা অন্য গুরুতর আঘাত হলে না হয় বোঝা যেত। কিন্তু সাধারণ একটা অস্ত্রোপচারের জন্য সাত লক্ষ টাকা বিল হলে মানুষ কোথায় যাবেন? জমিজমা বিক্রি করে আড়াই লক্ষেরও বেশি টাকা দিয়ে ছেলেটির বাবা ভেবেছিলেন, বোধহয় সব পাওনা মিটে গেল। তিনি বোঝেননি যে শোষণের আরও বাকি রয়েছে।”
স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা জেলা পরিষদ সদস্য স্বপন দাস বলেন, “সামান্য একটা অস্ত্রোপচারের পরে ছেলেটি কেন মারা গেল, আমরা সে বিষয়েও পুরোপুরি অন্ধকারে। মৃতদেহ না দেওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কেও আমাদের বিশদে কিছু জানানো হচ্ছে না।”
হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ অবশ্য অভিযোগ মানতে চাননি। সুপার উৎপল চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ছেলেটিকে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তখনই তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ওঁদের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে আমরা বিলের কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। এ-ও বলেছিলাম যে, ওঁরা অন্য কোথাও রোগীকে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু যা খরচ হবে, তা দেবেন বলে মুচলেকায় সই করে দিয়েছিলেন ছেলেটির বাবা। এখন অন্য কথা বলার কোনও জায়গাই নেই।” |