পুস্তক পরিচয় ১...
আধুনিকতার অভ্যেস রপ্ত হয়েছে কি?
ডিরেক্টরস কাট/ ফিফটি মেজর ফিল্ম-মেকারস অব দ্য মডার্ন এরা। এম কে রাঘবেন্দ্র, ৩৯৯.০০
বলিউড নেশন/ ইন্ডিয়া থ্রু ইটস সিনেমা, ভামসি জুলুরি। পেঙ্গুইন, ২৯৯.০০
রুটলেজ হ্যান্ডবুক অব ইন্ডিয়ান সিনেমাজ, সম্পা: কে মোতি গোকুলসিং ও উইমাল দিসানায়েক।
রুটলেজ, ১৪০ পাউন্ড (আনুমানিক ১৪০০০.০০)
ছর নয়েক আগে এক বার সত্যজিৎ রায় ও তাঁর ‘পথের পাঁচালী’র আসন্ন পঞ্চাশ বছর পূর্তি নিয়ে কথা বলতে, কলকাতায় এসেছিলেন আদুর গোপালকৃষ্ণন, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। কেরলের চলচ্চিত্রকারের সে বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। বলছিলেন, ‘ষাটের দশকে ক্যাম্পাসের কাল্ট-হিরো ছিলেন গোদার। সত্তর দশকে হলেন তারকোভস্কি। আর আশির দশকে কিয়েসলওস্কি। এবং এ রকম চলতেই থাকে। কিন্তু কখনওই সেখানে এক জন সত্যজিৎ রায় বা একজন মৃণাল সেন ঠাঁই পান না। যদি-বা ঋত্বিক ঘটক ফ্যাশন হয়ে ওঠেন, অল্প সময়ের জন্য অল্প কিছু ছাত্রের কাছে, তা-ও তা তাঁর অসামান্য কাজের জন্য নয়, তিনি এই গোটা ব্যবস্থাটার বাইরে ছিলেন বলে।’ পুণে-র ফিল্ম ইনস্টিটিউটের গল্প বলছিলেন আদুর, অথচ এই মানুষটার হাতেখড়ি কিন্তু ওই ফিল্ম ইনস্টিটিউটেই। আরও বলছিলেন: ‘ইউরোপের ছবি-করিয়েদের নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকত, বা হয়তো এখনও থাকে ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীরা। অথচ সেই দিক্পালদের দেশ-সংস্কৃতি সবই আলাদা।’ কোনও জাত্যাভিমানের কথা বলছিলেন না আদুর, কিন্তু তাঁর মনে হয়েছে: ‘Our colonial past has ingrained in us a deep sense of self deprecation and inferiority’। ফলে ভারতীয় কোনও শিল্পীকে সিনেমার পূর্বসূরি হিসেবে মেনে নিতে এখনও বেশ বাধো-বাধো ঠেকে আমাদের।
এম কে রাঘবেন্দ্র’র নতুন বই ডিরেক্টরস কাট পড়তে গিয়ে আদুরের কথাগুলো ফের নতুন করে মনে পড়ে গেল, কারণ বইটি শুরুই হয়েছে আদুরকে নিয়ে এক মনোজ্ঞ আলোচনায়। রাঘবেন্দ্র তাঁর এই বইতে আলোচনার বিষয় হিসেবে সারা দুনিয়ার পঞ্চাশ জন সেরা চলচ্চিত্রকারকে বেছে নিয়েছেন। আবার এও লিখেছেন, তাঁরা মডার্ন এরা-র, অর্থাৎ আধুনিক কালের চিহ্নে চেনা যায় এই সমস্ত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রকারকে। ভাল কথা, কিন্তু আমাদের দেশ থেকে ঠাঁই পেয়েছেন যে পাঁচ জন, তাঁদের মধ্যে আদুর ছাড়া আছেন কেরলের জি অরবিন্দন, সত্যজিৎ ও ঋত্বিক, এবং রাজ কপূর।
রাজ কপূরকে রাঘবেন্দ্র প্রথমেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন হিন্দি মূলধারার ছবির জনপ্রিয় পরিচালক হিসেবে, কিন্তু তাঁকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে লিখেছেন, তাঁর ছবিগুলি রীতিমতো ‘ন্যাশনাল’। তাই বুঝি? আদুর-অরবিন্দন-সত্যজিৎ-ঋত্বিক যে ভাবে স্বদেশকে চেনার চেষ্টা করেছেন, বা চেনানোর চেষ্টা করেছেন দর্শককে, রাজ কি সে ভাবেই চেষ্টা করতেন? স্বাধীনতার পর সিনেমায় সত্যজিতের হাতে স্বদেশ বা স্বাদেশিক সংকট যে ভাবে শিল্পগত সংহতি তৈরি করছিল, আমাদের ফিল্ম যে ভাবে শিল্প হিসেবে নিজস্ব আধুনিকতার সংজ্ঞা খুঁজে নিচ্ছিল, ঠিক তখনই পঞ্চাশের দশকে বম্বের মূলধারার প্রধানতম প্রতিভূ হিসেবে রাজ কপূরের ছবি ভারতীয় আধুনিকতার সে সংজ্ঞাকে একেবারে ভেঙে দিল। যে ভবঘুরে চরিত্র তৈরি করেছিলেন রাজ, সাদাকালো থেকে রঙিন ছবিতে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে তা ‘ট্র্যাম্প’ থেকে প্রায় ‘প্লেবয়’ হয়ে যায়। আজ একটা বাচ্চাও জানে, কতটা সরলীকরণের বাঁধা ছকে তাঁর ফিল্মের গল্পগুলি সাজানো থাকত, এমনকি সংলাপগুলি পর্যন্ত, এমনকি গানগুলি পর্যন্ত। প্রতিটি ফিল্মেই স্বাদেশিকতার নতুন স্বাদ দেবেন বলে ঘোষণা করতেন রাজ, কিন্তু তাঁর প্রতিটি ফিল্মেই ঘটনা একই পরম্পরায় ঘটে যেতে দেখত দর্শক, নতুন কোনও অভিজ্ঞতার স্বাদ তাতে পাওয়া যেত না।
রাজ কিন্তু তাঁর এই বাঁধা ছকের জন্যে গড় দর্শক তৈরি করে নিয়েছিলেন। বরং রাঘবেন্দ্র যদি ফিল্মের গড় গণিত আর দর্শকের গড়-গণিতকে সমানুপাতে এনে, রাজ কী ভাবে তাঁর ছবিতে দেশের দারিদ্রকে অত্যাবশ্যক পুঁজি করে তুলেছিলেন, সে আলোচনায় যেতেন, পাঠকের উপকার হত। জনপ্রিয় ছবির সমাজতত্ত্ব এখন তো প্রায় দৈনন্দিন চর্চার বিষয়। রাঘবেন্দ্র তা তো করলেনই না, উপরন্তু বাকি ঊনপঞ্চাশ জন সেরা পরিচালকের মধ্যে থেকে মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, মণি কল, কিংবা কুমার সাহানি-র মতো এ দেশের পূর্বসূরিদের বাদ দিয়ে দিলেন।
ভামসি জুলুরি-র বলিউড নেশন/ ইন্ডিয়া থ্রু ইটস সিনেমা-য় বরং জনপ্রিয় ছবির ভিতর দিয়ে দেশ খোঁজার একটা চেষ্টা। জনপ্রিয় সিনেমার সঙ্গে একদা রামায়ণ-এর মতো জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালকেও তিনি আলোচনায় টেনে এনেছেন। ভারতীয় ছবি ‘মিথোলজি’ থেকে ‘মেলোড্রামা’ হয়ে হালে ‘মাফিয়া’-বৃত্তান্তে কী ভাবে পৌঁছচ্ছে, সে পরিক্রমা অন্তত বোঝবার চেষ্টা তাঁর রচনায়। তাঁর রচনা খুরধার বিশ্লেষণ নয়, খুব যে গভীর চিন্তা উসকে দেয়, তাও নয়। তবে বলিউডের ছবি কোন ধরনের ভারতীয়তার সংজ্ঞা তৈরি করছে, তার একটা হদিশ অন্তত দেয়। স্বাদেশিকতার বিভ্রান্তিকর সংজ্ঞা তৈরি করে না।
রুটলেজ হ্যান্ডবুক অব ইন্ডিয়ান সিনেমাজ অবশ্য ভারতীয় সিনেমা নিয়ে ভারসাম্যমূলক বই। ঐতিহাসিক পর্যায়, আঞ্চলিক বিভাগ থেকে শুরু করে ভারতীয় ছবির বাণিজ্যের ধরন-ধারণ অবধি পৌঁছেছে রচনার বিষয়াদি। কর্পোরেট দুনিয়ার সঙ্গে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গাঁটছড়া নিয়ে চমৎকার আলোচনা তেজস্বিনী গান্তির। ডিজিটাল টেকনোলজি, বিজ্ঞাপন, সিনেমা হল, পরিবেশনা, দর্শক ইত্যাদি নিয়েও প্রয়োজনীয় রচনা বইটিতে। অসম্ভব পরিশ্রমী রচনা ‘ফিল্ম সেন্সরশিপ’ নিয়ে সোমেশ্বর ভৌমিকের এবং প্রেমেন্দ্র মজুমদারের ‘মিউজিক ইন মেনস্ট্রিম ইন্ডিয়ান সিনেমা’। এমনই আর একটি রচনা সোমা এ চট্টোপাধ্যায়ের ‘দ্য এভোলিউশন অব রিপ্রেজেন্টিং ফিমেল সেক্সুয়ালিটি ইন হিন্দি সিনেমা/ ১৯৯১-২০১০’।
এ সবই সাধু প্রচেষ্টা সন্দেহ নেই, তবে কবিতা-নাটক-গল্প-উপন্যাস-চিত্র-ভাস্কর্য-সংগীত-নৃত্য-অভিনয় এই সব সাবেকি শিল্পরূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় অনেক দিনের। সিনেমার সঙ্গে পরিচয়টা নতুন, ফলে যন্ত্রনির্ভর মাধ্যমটির ক্ষেত্রে আমাদের শিল্পভাবনার আধুনিকতায় ফিল্মের প্রকরণ অনাত্মীয় রয়ে গেছে গোড়া থেকেই। আজ ফিল্মের যন্ত্রনির্ভরতার সঙ্গে হয়তো এক ধরনের আত্মীয়তা তৈরি হয়েছে, কিন্তু যন্ত্রকে নিঃশেষে ব্যবহার করে কী ভাবে পৌঁছনো যেতে পারে শিল্পের বিমূর্তে, সে অভ্যেস রপ্ত হয়েছে কতটা?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.