সাপ মারবেন না, গ্রামে গিয়ে বোঝাচ্ছেন বিশাল-হিন্দোলেরা
বাক্সবন্দি একটি শাঁখামুটিকে নিয়ে চণ্ডীতলা ১ ব্লক প্রাণী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঢুকলেন শশব্যস্ত যুবক। সাপটির শরীরের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। চণ্ডীতলার বাঁদপুর গ্রামে সম্ভবত বর্শা জাতীয় কিছু দিয়ে সেটিকে খোঁচানো হয়েছিল। কর্তব্যরত চিকিৎসক সঙ্গে সঙ্গে সাপটির শরীরের পচন ধরা অংশ কেটে বাদ দিলেন। ওষুধ লাগানো হল ক্ষতস্থানে। সেলাই পড়ল। কয়েক দিন পর্যবেক্ষণে থাকার পরে সাড়ে ৪ ফুট লম্বা প্রাণীটি দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠল।
সাপটির উদ্ধারকর্তা হিন্দোল আহমেদের মুখে তখন যেন যুদ্ধজয়ের হাসি! শুধু হিন্দোল নয়, বিশাল, রাজকুমার, প্রশান্ত, অরিত্ররাও সামিল এই সাপ বাঁচানোর ব্রতে। এঁরা সকলেই হুগলির নালিকুলের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য। তাঁদের কাজই হল লোকালয়ে সাপ ঢুকে পড়ার খবর পেয়ে সেটিকে উদ্ধার করে আনা। প্রয়োজন হলে প্রাণীটির পরিচর্যা করে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া। কখনও স্কুলে-কলেজে সেমিনার বা পথসভা করা। উদ্দেশ্য একটাই প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাপ মারা যে অনুচিত, তা গ্রামবাসীকে বোঝানো। এবং সাপে কাটলে অযথা ভয় না পেয়ে কী করা উচিত, সে বিষয়ে সচেতন করা। সাপের ছোবলের সঞ্জীবনী যে ওঝার ঝাড়ফুঁকে নেই, বরং আছে সঠিক চিকিৎসায় সাধারণ মানুষকে দিনরাত তা-ই বুঝিয়ে চলেছেন ‘শিমুলতলা কনজার্ভেশনিস্ট’ নামে ওই সংগঠনের সদস্যেরা। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকরাও পরামর্শ নেন, কোন পথে এগোবে চিকিৎসা।
আহত শাঁখামুটি সাপটির চিকিৎসা চলছে। —ফাইল চিত্র।
এ সবের ফলও মিলছে। স্থানীয় বিভিন্ন গ্রামের কাউকে সাপে কাটলে বাড়ির লোক খবর দিচ্ছেন বিশাল, হিন্দোলদের। আবার কখনও হাসপাতাল থেকেও খবর মিলছে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে যাচ্ছেন তাঁরা। দিনে না রাতে কোন সময় সাপে কেটেছে, ক্ষতস্থানে জ্বালা করছে কি না, অন্য কোনও উপসর্গ আছে কি না এমন সব তথ্য দ্রুত জেনে নেন তাঁরা। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন। সেই মতো চিকিৎসা চলে। মানসিক ভাবে শক্তি জোগানো হয় রোগীকে। চলতি বছরে এমন অন্তত ৩০ জন সর্পদষ্টের হাসপাতালে চিকিৎসা হয়েছে এই সংগঠনের ছেলেদের উপস্থিতিতে। একটি বালক ছাড়া সকলেই সেরে উঠেছেন। তথ্য বলছে, মৃত বালকের পরিবার প্রথমে ওঝার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন।
সর্প দংশন নিয়ে কাজ করছেন কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র গ্রেড ২ মেডিক্যাল অফিসার দয়ালবন্ধু মজুমদার। নালিকুলে সংগঠনটির কাজকর্ম সম্পর্কে অবহিত এই সর্প বিশেষজ্ঞ। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “ছেলেগুলো সত্যিই সমাজের বন্ধু। যে ভাবে ওঁরা বিষয়টি নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন এবং সরাসরি কাজ করছেন, তা প্রশংসনীয়।”
হিসেব বলছে, গত দু’মাসে সংগঠনের সদস্যরা ৫৬টা সাপ ধরেছেন। এর মধ্যে ৫১টাই বিষধর। সংগঠনের বাৎসরিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে গত ৪ নভেম্বর থেকে। চলবে ১০ তারিখ পর্যন্ত। এই ক’দিন জেলার বিভিন্ন জায়গায় বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত সেমিনার, ক্যুইজ, পথসভা আয়োজিত হচ্ছে। নালিকুল ন’পাড়ার বাসিন্দা পরাণ কোলেকে কিছু দিন আগে বিষধর সাপ দংশন করেছিল। হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে তিনি এখন সুস্থ। তাঁর কথায়, “ওই যুবকদের জন্য গ্রামবাসীরা উপকৃত হচ্ছেন। সাপে ছোবল মারার পরে কুসংস্কারবশত ওঝার বাড়ি যাওয়াটা অনেক গ্রামেই এখনও রেওয়াজ। ওই সংগঠনের সদস্যদের লাগাতার প্রচারে মানুষের এই ভুল ভাঙছে।”
বছর খানেক আগে হরিপালের কিঙ্করবাটি গ্রামের এক যুবককে সাপে কেটেছিল। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসায় তিনিও এখন তিনি মোটামুটি সুস্থ। তাঁর বাড়ির লোকজন জানালেন, গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা প্রথমে বুঝতেই পারেননি আদৌ সাপে কেটেছে কি না। যন্ত্রণা বাড়তে থাকায় পরীক্ষা করানো হয়। ওই যুবকের আত্মীয় তরুণ কোলে বলেন, “যন্ত্রণা বাড়তে থাকায় বিশালদাদের খবর দিই। সে ক্ষতস্থান দেখেই বলে, চন্দ্রবোড়ায় কেটেছে। তার পরেই পরীক্ষার রিপোর্ট আসে। এভিএস চালু হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় রোগীকে এসএসকেএম নিয়ে যেতে হয়। তখন এভিএসের আকাল চলছে। বিশালদারাই দৌড়ঝাপ করে এভিএস জোগাড় করে দিল। ডাক্তারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলল।” তরুণবাবুর কথায়, “সে দিন ওরা পাশে না থাকলে কী হত কে জানে! ওদের উপকার কোনও দিন ভুলব না।”
আর বিশাল সাঁতরা, রাজকুমার চক্রবর্তীদের বক্তব্য, “সাপ খুব উপকারী বন্ধু। বিশেষ করে চাষিদের। অহেতুক ভয় থেকে এদের মেরে ফেললে তার প্রভাব জমি এবং বাস্তুতন্ত্রের উপরে পড়ে। তা ছাড়া, বিষধর সাপের ছোবল খেলেও খুব সহজেই চিকিৎসা সম্ভব। এ সব কথাই আমরা গ্রামে গ্রামে (অনেক সময় শহরাঞ্চলেও) গিয়ে বোঝাই। তাতে যে অল্প হলেও কাজ হচ্ছে, সেটাই আমাদের প্রাপ্তি!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.