ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন স্পষ্ট বলিয়া দিলেন, নয়াদিল্লি লন্ডনের অতি মূল্যবান মিত্র। একই সময়ে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ খোলা গলায় ঘোষণা করিয়াছেন, নাইজিরিয়া যেন ভুলিয়া না যায়, সে ভারতের প্রিয় মিত্র দেশগুলির অন্যতম। প্রীতি-জ্ঞাপনের আন্তঃমহাদেশীয় বাড়াবাড়ি দেখিয়া প্রথমটা চোখে ধাঁধা লাগিতে পারে। তবে অন্তর্নিহিত রহস্যটি অতি সরল। ব্রিটেন যে রকম সে দেশের মাটিতে ভারতীয় অভিবাসেচ্ছু জনতা লইয়া হিমশিম খাইতেছে, অবৈধ অভিবাসন আটকাইবার লক্ষ্যে মাঝেমধ্যেই বাড়াবাড়ি করিয়া ফেলিতেছে, এবং সেই বাড়াবাড়ি সামলাইতে বন্ধুত্বের উদার আশ্বাসবাক্য বিতরণ করিতেছে, ভারতও ঠিক একই ভাবে গোয়ায় নাইজিরিয়া হইতে আগত অবৈধ অভিবাসীদের লইয়া সংকটাপন্ন, নাইজিরীয় বাসিন্দাদের সহিত আঞ্চলিক বাসিন্দাদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে উদ্বিগ্ন, এবং সেই দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতি সামাল দিতে আবুজার প্রতি আপাতত মিষ্টবাক্য বিতরণে উদ্যত। সমগ্র পরিস্থিতি দেখাইয়া দেয়, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের নিগড় যত শক্তপোক্ত করিবার চেষ্টাই হউক, জল সমানে জলতল সমান করিবার জন্যই প্রবাহিত হইবে, দরিদ্রতর দেশ হইতে মানুষ ক্রমাগত সম্পন্নতর দেশের দিকে ধাবিত হইবে।
কিছু কাল আগেই ব্রিটিশ সরকার এই অবৈধ অভিবাসন আটকাইবার জন্য একটি বজ্রাদপি কঠোর পদক্ষেপের কথা ভাবিতেছিল। প্রস্তাব উঠিয়াছিল, ভারত, পাকিস্তান, নাইজিরিয়া ইত্যাদি যে ছয়টি দেশের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ সাময়িক ভিসা লইয়া ব্রিটেনে পদার্পণ করিয়া ভিসা পার হইয়া যাইবার পরও মহানন্দে সে দেশে থাকিয়া যান, সেই সব দেশের জন্য ৩০০০ পাউন্ডের ‘বন্ড’ চালু বইবে: একমাত্র সেই বন্ড কিনিলেই ভিসা পাওয়া যাইবে, নতুবা নয়। নিহিতার্থ: যদি কেহ ভিসা অমান্য করিয়া থাকিয়া যায়, তাহার ক্ষেত্রে ওই অর্থ বাজেয়াপ্ত হইবে। নির্ধারিত সময়ে ফিরিয়া গেলে অর্থ ফেরত। অর্থাৎ অপরাধের আগেই আগাম শাস্তির ব্যবস্থা। স্বভাবতই ব্রিটেনে ভারতীয় নাগরিকদের যে ‘লবি’, তাহারা হইহই রবে আপত্তি জানাইয়াছিল। নয়াদিল্লিও অপ্রীতি-প্রতিক্রিয়া গোপন রাখে নাই। ভারত যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়া ব্রিটেনের যথেষ্ট ভরসার দেশ, সে দেশের সহিত যে এমত কুব্যবহার করা যায় না, লাগাতার সেই প্রচার চলিল। প্রচারে কাজও হইল। কয়েক দিন আগে এই পরিকল্পনা বাতিল হইয়াছে। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন প্রায় ক্ষমা স্বীকার করিয়া বলিয়াছেন, ভারত কখনওই এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল না।
গোয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য ভারত কিংবা গোয়ার সরকার এখনও পাসপোর্টবিহীন নাইজিরীয়দের ঘর বাঁধিয়া থাকিয়া যাইবার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ লয় নাই। আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং হাঙ্গামায় সম্প্রতি এই নাইজিরীয়ের হত্যার প্রেক্ষিতে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পারিক্কর যদিও গোয়াবাসীদের আশ্বস্ত করিয়াছেন, তিনি অবৈধ অভিবাসীদের তাড়াইয়া ছাড়িবেন। তাঁহার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য আরও এক পা আগাইয়া বলিয়াছেন, এই নাইজিরীয় সমস্যা গোয়ার নিকট ক্যানসার রোগের সমতুল্য, যোগ্য প্রতিকার চাই। স্বভাবতই কয়েক সহস্র নাইজিরীয় নাগরিকের প্রতি এই হুমকি আবুজাকে খুশি করে নাই, নয়াদিল্লি তাই অবস্থা সামাল দিতে আপাতত প্রীতিবার্তা পাঠাইতে ব্যস্ত। হুমকি ও শাস্তির রাজনীতি ছাড়িয়া বিষয়টিকে কূটনীতির অঙ্গনে লইয়া আসাই প্রতিকারের সদুপায়। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় জলপ্রবাহ দুর্নিবার। অর্থনীতির বৈষম্য প্রবাহের গতি স্থির করিবেই। কোনও শাস্তি বা হুমকি তাহার নিরাময় নয়। তাহাতে বরং উল্টা ফল ফলিবার সম্ভাবনা। |