দীপাবলির রাত। রেশম জরির কাজ করা আকাশ নীল রঙের বালুচরি শাড়িতে সেজে পোর্ট অব স্পেনে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের বারান্দায় এক-একটি করে দীপ জ্বালিয়েছেন ফার্স্ট লেডি রিমা হরিসিংহ কারমোনা। চিত্রগ্রাহকদের সামনে ‘পোজ’ দিয়েছেন হাসিমুখে। বিষ্ণুপুরের বালুচরিতে তিনি কতটা মজে
রয়েছেন, তা জনে-জনে জানিয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ৪২ বছরের প্রেসিডেন্ট-পত্নী।
রিমার এ হেন বালুচরি-প্রেমের জেরেই সুদূর ত্রিনিদাদ-টোবাগোর রাজধানী শহরে বাংলার বালুচরি শাড়ি ও হস্তশিল্পের স্থায়ী বিপণি খুলতে আগ্রহ দেখিয়েছে সে দেশের সরকার। নিজের ব্যক্তিগত সচিব মারফত তাঁর ইচ্ছের কথা জানিয়ে নভেম্বরের শুরুতেই কলকাতায় বালুচরি শিল্পীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে চিঠি পাঠিয়েছেন ফার্স্ট লেডি। তাতে বালুচরির ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি লিখেছেন, ‘‘শুধু বালুচরির বিপণি নয়, বালুচরি শিল্পের প্রসার ও শিল্পীদের উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী রিপাবলিক অফ ত্রিনিদাদ ও টোবাগো।’’ |
চিঠির বয়ানে রয়েছে, ‘‘বালুচরি শাড়ি অসাধারণ! তাঁতশিল্প বাংলার সম্পদ। তাকে রক্ষায় আমরা সব সময় বাংলার পাশে থাকতে চাই। ভারত ও ত্রিনিদাদ-টোবাগোর ঐতিহ্যের অনেক মিল। তাই দু’দেশ একসঙ্গে কাজ করলে দু’জনেরই লাভ।’’ মহাকরণ সূত্রের খবর, ভিন্ দেশের প্রেসিডেন্ট-পত্নীর বালুচরি-প্রীতির বিষয়টি কানে এসেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। সব শুনে তিনিও খুব খুশি।
উচ্ছ্বসিত ক্ষুদ্রশিল্প দফতরও। বিভাগীয় মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের কথায়, “অত্যন্ত উৎসাহের কথা। আমরাও ওঁদের সঙ্গে কাজে আগ্রহী। আমরাও চাই বালুচরি, স্বর্ণচরীর মতো শাড়ি আরও বেশি করে বিদেশে বিক্রি হোক। আর্থিক সংস্থান হোক শিল্পীদের।” বস্তুত, কিছু দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের দশটি হস্তশিল্প নিয়ে তিনি বিশ্বের দরবারে যেতে চান। তার মধ্যে অন্যতম ছিল বালুচরি শাড়ি। তাই ত্রিনিদাদের এই আগ্রহকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
তাঁতের টানাপোড়েনে উৎপন্ন ‘রেশমের ফসল’ বলা হয় বালুচরিকে। বিষ্ণুপুর তার আঁতুরঘর। ২০০৬ সাল থেকে বিষ্ণুপুরের রাধানগর ও আশপাশের গ্রামের বালুচরি শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করে ‘ফ্রিড’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তার প্রধান সোমনাথ পাইন জানালেন, বিদেশিদের ওই সব গ্রামে নিয়ে গিয়ে তাঁরা বালুচরি শাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করে থাকেন। তাতে কিছুটা লাভের মুখ দেখেন শিল্পীরা। ইতালি থেকে আসা একদল পর্যটক বেশ কিছু বালুচরি কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইতালি সফরে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে ঘটনাচক্রে দেখা হয় ত্রিনিদাদ-টোবাগোর প্রেসিডেন্ট অ্যান্টনি থমাস কার্মোনা ও তাঁর স্ত্রী রীমার। রীমা ভারতীয় বংশোদ্ভূত জেনে কথায়-কথায় ওঠে বালুচরি প্রসঙ্গ। সেখানেই আগ্রহ দেখান ফার্স্ট লেডি।
সেই কথা জানতে পেরে তাঁর জন্য দু’টি বালুচরি উপহার পাঠিয়েছিলেন সোমনাথবাবুরা। একটি গাঢ় মেরুন রঙের, আর একটি নীল। দ্বিতীয় শাড়িটি পরেই দীপাবলি পালন করেন রিমা। তার পরেই আসে চিঠি। এতে উৎসাহিত বিষ্ণুপুরের বালুচরি শিল্পীরাও।
ফার্স্ট লেডির শাড়ি যাঁরা তৈরি করেছেন, সেই শিল্পী লালু রক্ষিত, ধনঞ্জয় রক্ষিত, নির্মল খাঁয়েরা জানালেন, বালুচরি শাড়ির বিক্রি ক্রমশ কমছে। বিষ্ণুপুরে এক সময় ৫ হাজার তাঁত ছিল। এখন টিকে রয়েছে মাত্র ৫০০-৭০০টি। টানা রেশম সুতোর প্রতি কিলোগ্রাম ছিল ২৬০০ টাকার মতো। তা বেড়ে এখন প্রায় ৯৩০০-৯৭০০ টাকা দাম হয়েছে। অথচ গত কয়েক বছর বালুচরির দাম বাড়েনি। এই অবস্থায় সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে যদি বালুচরি-বাণিজ্যের নতুন ঠিকানা মেলে, মন্দ কি? |