ঈশ্বরের’ খোঁজ দিয়েছে জেনিভা। এ বার ‘ভূতের’ খোঁজে নামল মাদুরাই।
গত বছর হিগস-বোসন বা গড পার্টিকলের সন্ধান নিয়েই মেতে ছিল বিশ্ব। জেনিভার সার্নের এই সাফল্য নোবেল এনে দিয়েছে কণার আবিষ্কর্তা পিটার হিগসকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, হিগস বোসনের পাশাপাশি পদার্থবিদ্যার জগতে আরও একটি রহস্যময় কণা রয়েছে। নিউট্রিনো বা ভুতুড়ে কণা! সেই কণার অস্তিত্ব সন্ধানেই ১৫০০ কোটি টাকা খরচ করে তামিলনাড়ুর মাদুরাই থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম বোড়ি পাহাড়ের তলায় একটি গবেষণাগার তৈরি করা হচ্ছে। নাম, ইন্ডিয়া-বেসড নিউট্রিনো অবজারভেটরি (ইনো)। ওই গবেষণাগারে বসে ভুতুড়ে কণার সন্ধান চালাবেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। এই প্রয়াস অবশ্য দীর্ঘদিনের। তবে গবেষণাকেন্দ্র তৈরির জমি নিয়ে পরিবেশবিদ্দের ছাড়পত্র মিলছিল না কিছুতেই। শেষমেশ শিকে ছিঁড়ল।
কী এই ভুতুড়ে কণা? কেনই বা এমন নাম? বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভুতুড়ে কণা বা নিউট্রিনো একটি সামান্য ভরবিশিষ্ট তড়িৎবিহীন কণা। ব্রহ্মাণ্ডের নানা বাধার ভিতর দিয়ে অনায়াসে চলে যেতে পারে এই কণা। “সিনেমার ভূত যেমন ঘর-বাড়ির দেওয়াল, কাচ ভেদ করে বিনা বাধায় চলে যেতে পারে, এই কণাও তেমনই ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনও বস্তুর ভিতর দিয়ে বিনা বাধায় চলে যায়। সে কারণেই একে ভুতুড়ে কণা বলে।”মন্তব্য এক পদার্থবিজ্ঞানীর।
সাধারণত, তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া থেকেই এই কণার উৎপত্তি হয়। সূর্যের অন্দরে নানা তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া, পরমাণু গবেষণাগারের অ্যাক্সিলারেটর, ব্রহ্মাণ্ডে সুপারনোভা বিস্ফোরণ প্রভৃতি থেকে অনর্গল এই কণা নির্গত হচ্ছে। তা ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবী-সহ মহাবিশ্বের সর্বত্র। পদার্থবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, এই কণা দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়লেও কোনও প্রভাব ফেলে না। সূর্যের আলোর সঙ্গেই ঝাঁকে ঝাঁকে নিউট্রিনো বয়ে চলেছে। কিছু মালুম হয় না কখনই। বাড়ি-ঘর, মানব দেহ ভেদ করে দিব্যি বহমান। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওই কণা! যদিও এ সব তথ্য জানা থাকলেও হাতে নাতে প্রমাণ নেই। তাই অস্তিত্বের সন্ধানে নামছেন বিজ্ঞানীরা।
ইতিহাস বলছে, ১৯৩০ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ উলফগ্যাং পাউলি প্রথম এই কণার কথা জানান। তবে সেই কণার হদিস দিতে পারেননি তিনি। ১৯৫৫ সালে ক্লিড কাওয়ান, ফ্রেডরিক রেইনস-সহ পাঁচ বিজ্ঞানী দাবি করেন, পরমাণু গবেষণায় তাঁরা নিউট্রিনো তৈরির পদ্ধতি লক্ষ্য করেছেন। যদিও নিউট্রিনোর চরিত্র সম্পর্কে এর থেকে বেশি জানা যায়নি। নিউট্রিনো রহস্যে বিশ্বের নানা দেশে অবশ্য গবেষণা শুরু হয়েছে অনেক দিন ধরেই। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, জাপানের কামিওকা পাহাড়ে ‘কামিওকান্ডে’ কিংবা দক্ষিণ মেরুতে ‘আইস-কিউব’ নিউট্রিনো পরীক্ষাগার রয়েছে। কিন্তু এখনও সেখানে নিশ্চিত ফল বেরোয়নি। চরিত্র সন্ধান হয়নি ভুতুড়ে কণারও। উন্নত দেশগুলির পাশাপাশি কণা-চরিত্র সন্ধানে এ বার নামছে ভারতও! কী ভাবে?
মাদুরাই থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে থেনি জেলায় পশ্চিম বোড়ি পাহাড়ের তলায় মাটি খুঁড়ে প্রায় ১ কিলোমিটার গভীরে ২১০০ মিটার লম্বা একটি সুড়ঙ্গ বসানো হচ্ছে। তাতে রয়েছে আয়রন ক্যালোরিমিটার নামে একটি ডিটেক্টর। মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাবে পৃথিবীর আবহমণ্ডলে তৈরি হওয়া নিউট্রিনো পৃথিবীকে ভেদ করে চলে যায়। আপাতত সেগুলিকেই পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্যের আলোয় নিউট্রিনোর সঙ্গে অন্যান্য কণাও চলে আসে। সেগুলি যাতে টানেলে ঢুকতে না পারে, তার জন্যই পাহাড়ের নীচে ভূগর্ভস্থ ওই সুড়ঙ্গ খোঁড়া হচ্ছে। পাথর নিউট্রিনো ছাড়া অন্য কণা শুষে নেবে। ফলে পরীক্ষায় ব্যাঘাত ঘটবে না।
এ দিন কলকাতায় সায়েন্স সিটিতে ‘ইনো’র এক আলোচনাচক্রে প্রকল্পের অধিকর্তা তথা টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের বিজ্ঞানী নবকুমার মণ্ডল জানান, আয়রন ক্যালোরিমিটার তৈরি করতে ৫০ হাজার টন চৌম্বক-লোহার পাত লেগেছে। দু’টি লোহার পাতের মাঝামাঝি রাখা হয়েছে রেজিস্টিভ প্লেট চেম্বার নামে বিশেষ যন্ত্র। নববাবু বলেন, “প্রচুর নিউট্রিনো ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে অতিক্রম করলেও খুব সামান্য পরিমাণেই ওই ডিটেক্টরে ধরা দেবে।” বিজ্ঞানীদের একাংশ জানিয়েছিলেন, এই গবেষণায় জাপান-সহ অন্য দেশের সঙ্গেও যৌথ ভাবে কাজ করতে পারে ভারত। এ দিন ব্যাপারটি স্বীকার করেছেন নববাবুও। তিনি বলছেন, “প্রথম পর্যায়ে আবহমণ্ডলে তৈরি হওয়া নিউট্রিনো নিয়ে কাজ চলবে। তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্য দেশের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে।” তিনি জানান, বিদেশের কোনও একটি জায়গা থেকে নিউট্রিনো তৈরি করে ছাড়া হবে। সেই নিউট্রিনো এসে পৌঁছবে মাদুরাইয়ের সুড়ঙ্গেও।
বিজ্ঞানীদের আশা, ভুতুড়ে কণা-চরিত্র সন্ধানে নজিরও গড়বে ভারত। এ পর্যন্ত বিশ্বের সব থেকে বড় চুম্বক বা এই ধরনের ডিটেক্টর সার্ন গবেষণাগারের সিএমএস। আগামী দিনে ভারতের আয়রন ক্যালোরিমিটার তার জায়গা নিতে পারে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
হিগস-বোসন সন্ধানের সময় বিজ্ঞানীরা জানান, বিশ্বে যে কোনও কণার ভর অর্জনের পিছনে দায়ী এই কণাই। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির অন্যতম রহস্য লুকিয়ে রয়েছে হিগস-বোসন কণাতেও। ভুতুড়ে কণার নিশ্চিত সন্ধান পেলে কী জানা যাবে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে ‘বিগ ব্যাং’ বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তৈরি হয় ‘ম্যাটার’ ও ‘অ্যান্টি ম্যাটার’। সৃষ্টির পরেই পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ায় ম্যাটার ও অ্যান্টি-ম্যাটার, দু’টোরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। তা হলে ‘ম্যাটার’ বা পদার্থ দিয়ে এই ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হল কী করে? সেই রহস্যেরই খোঁজ করছেন বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা। নববাবু বলেন, “নিউট্রিনোর চরিত্র সন্ধান করতে পারলে ব্রহ্মাণ্ডের এই রহস্যের ব্যাখ্যা মিলতে পারে।”
তার সমাধানেই এখন ভূতের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত বিজ্ঞানীরা। |