আলুতে শিক্ষা হয়নি, নজর ধানেও
কা আলুতে রক্ষা নেই, ধান দোসর!
কৃষি বিপণন দফতরের ভার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন বুধবার। কিন্তু বৃহস্পতিবারেও গৃহস্থের বাড়িতে আলু যায়নি বাজার থেকে। বরং সরকারি হুমকি, পুলিশ ও শাসক দলের নেতাদের হম্বিতম্বিতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে বলে অভিযোগ। তারই মধ্যে বৃহস্পতিবার রাজ্য সরকারের আর একটি সিদ্ধান্তে এ বার চালকলগুলিতে ধান ঠিক মতো পৌঁছবে কি না তা নিয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার নবান্নে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার এ বার চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনবে। সেখানে কোনও ফড়েকে বরদাস্ত করা হবে না। সরকারি ধান সংগ্রহ শুরু হওয়ার পরও যদি কোনও আড়তদার চাষির কাছে ধান কেনেন, তা হলে তাঁকে গ্রেফতার করা হবে।
এই নির্দেশ ঘিরে যথারীতি আরও এক বার অশনি সঙ্কেত দেখতে শুরু করেছেন রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তা থেকে শুরু করে ধান ব্যবসায়ী এবং কৃষকদের একাংশও। কেন? কারণ, মানুষের স্বার্থ দেখার কথা বলে সরকার ইতিমধ্যেই একাধিক ক্ষেত্রে যে নীতি নিয়েছে এবং নিজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা রূপায়ণ করতে গিয়ে যে জটিলতা ডেকে এনেছে, ধান কেনার ক্ষেত্রেও তারই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
কী রকম? ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেই হাতে গরম উদাহরণ টেনে আনছেন আলু। তাঁদের দাবি, সরকার আলু বিক্রির ব্যাপারে যত জড়াচ্ছে, মানুষের ভোগান্তি তত বাড়ছে। মানুষ বাজার থেকে ১৬ টাকায় আলু কিনছিলেন। রাজ্য সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ করে দেওয়ার ফলে বাজার থেকে আলু উধাও। সরকারি দরে আলু যা আসছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। কোথাও কোথাও মানুষকে ২০ থেকে ২২ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে আলু। নিট ফল? সাধারণ মানুষ আলু না-পেয়ে সঙ্কটে, অন্য দিকে পুলিশের চাপে সরকারি দরে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে কিছু বিক্রেতা লোকসানের ঠেলায় গলদঘর্ম। কলেজ স্ট্রিট বাজারের এক দোকানির মন্তব্য, “আলু বেচা কি সরকারের কাজ! এতে তো মরবে শত শত খুচরো ব্যবসায়ী। সরকার কি তাঁদের কথা এক বারও ভাববে না?”
বৃহস্পতিবার কোথাও পুরসভার কাউন্সিলর, কোথাও পুলিশ-প্রশাসন, কোথাও বা শাসক দলের কর্মী আলু বিক্রি করতে সক্রিয় ভাবে নেমে পড়েছিলেন সবাই। তবু আলু পাননি মানুষ। যদিও সরকারি এক পদস্থ অফিসারের দাবি, “অভিজ্ঞতা না-থাকায় প্রথম দিকে একটু গোলমাল হবে। দু’এক দিন পরেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।”
কিন্তু ঘটনা হল, সরকার হস্তক্ষেপের ব্যাপারে জেদ ধরে থাকায় বাস সমস্যার সমাধান তো হয়ইনি, উল্টে আরও জটিল হয়েছে। লোকসানের বোঝা বইতে না-পেরে বসে গিয়েছে বেসরকারি, এমনকী সরকারি বাসেরও একটা বড় অংশ। ফলে সাধারণ মানুষকে বাসভাড়ার তিন থেকে চার গুণ পয়সা খরচ করে অটো বা অন্য পরিবহণ মাধ্যমে যাতায়াত করতে হচ্ছে। অর্থাৎ যাঁদের উপর থেকে চাপ কমাতে রাজ্য সরকার বাস ভাড়া বাড়াচ্ছেন না, বাস বসে যাওয়ায় তাঁদেরই সব থেকে ভোগান্তি হচ্ছে।
প্রশাসনিক কর্তাদের একটা অংশও স্বীকার করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দক্ষতা এবং পরিকাঠামোর অভাবেই আলু সঙ্কট মেটানো যাচ্ছে না। এ বার একই ঘটনা ধান বিক্রির ক্ষেত্রেও ঘটবে এবং তাতে আখেরে কৃষকরাই সব থেকে বেশি বিপদে পড়বেন বলে খাদ্য দফতরের কর্তাদের আশঙ্কা।
ধান কেনার ব্যাপারে সরকার কী করতে চায়?
ক্ষমতায় এসেই বিভিন্ন এলাকায় শিবির বসিয়ে সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। তখন তা সফল হয়নি।
কিন্তু বৃহস্পতিবার ধান-চাল সংগ্রহ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বিশেষ গোষ্ঠীর বৈঠকের পর রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, “এ বছর মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের জমানা শেষ হবে।”
কী ভাবে? চাষিরা যাতে সরাসরি সরকারি সংস্থাগুলিকে ধান বিক্রি করতে পারেন, সে জন্য খারিফের ধান উঠলেই এক হাজার বিশেষ শিবির করা হবে। ২৮ নভেম্বর থেকেই এই শিবির শুরু হচ্ছে। প্রতি কুইন্টাল ১৩১০ টাকা দরে ৩৫ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। মন্ত্রীর কথায়, “আড়তদাররা সরকারি মূল্যে ধান কেনেন না। চাষিদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে তাঁরা চালকলে সরকারি দামে ধান বিক্রি করেন। যে টাকা চাষির প্রাপ্য, সেই টাকা খেয়ে যান আড়তদারদের মতো ফড়েরা।” এই প্রক্রিয়াটাই এ বার বন্ধ করতে চাইছে সরকার।
কিন্তু খাদ্য দফতরের কর্তাদেরই একাংশ বলছেন, রাজ্যের ৩৭ হাজার গ্রামে চাষিদের ঘরে ঘরে গিয়ে ধান কেনা খাদ্য দফতরের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারি সমবায় সংস্থাগুলিকে এ কাজে নামালেও লক্ষ্যপূরণ করা শক্ত। তাই চাষিরা অনেকেই শেষ মুহূর্তে আড়তদারদের কাছে কম মূল্যে চাল বিক্রি করতে বাধ্য হবেন বলেই আশঙ্কা। চাষিরা নিজেরাও জানাচ্ছেন, স্থানীয় আড়তদার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়ে ধান কেনেন। এটা বন্ধ হয়ে গেলে সমস্যায় পড়তে পারেন অনেক চাষিই। নদিয়ার হোগলবেড়িয়ার চাষি খগেন মণ্ডল যেমন বলেন, “সরকার কী বলেছে, তা আমার জানা নেই। তবে সীমান্তের এই এলাকায় আমরা আড়তদারদের কাছেই ধান বিক্রি করি। এটাই আমাদের কাছে সুবিধাজনক মনে হয়। নিজেরা উদ্যোগী হয়ে অন্যত্র ধান বিক্রি করতে গেলে লাভের থেকে লোকসানই বেশি হয়ে যায়।” কেন লোকসান?
খাদ্য দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা, রাজ্যের অধিকাংশ চাষির হাতে জমির পরিমাণ সামান্য। ফলে তাদের উৎপাদনের পরিমাণও অল্প। তাই দূরের সরকারি কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে ধান বিক্রি করতে যে পথের খরচ, সেটা তাঁরা কুলিয়ে উঠতে পারেন না। খয়রাশোলের ভাদুলিয়া গ্রামের চাষি রামকৃষ্ণ পাল যেমন সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করেও বলেন, “আমাদের ব্লকে চাল কল নেই। আছে সব থেকে কাছে দুবরাজপুরে, ২৫ কিমি দূরে। এ ক্ষেত্রে ট্রাক্টর বা গাড়ি ছাড়া ধান নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।”
চাষিদের মতো আশঙ্কায় রয়েছেন আড়তদারেরাও। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, আড়তদারি তো খারাপ কাজ নয়! বরং এই কাজকে আইনি সিলমোহর দিতে রাজ্যের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল। আড়তদারদের সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ ধান্য ব্যবসায়ী সমিতির এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা তো সরকারের কাছে বৈধ ব্যবসা করার লাইসেন্স চেয়েছি। কিছু বাড়তি অর্থের সংস্থান করে আমাদের মাধ্যমেই তো সরকার ধান সংগ্রহে নামতে পারে।” আবার বীরভূমের ধান্য ব্যবসায়ী সমিতির আহ্বায়ক প্রফুল্লকুমার গড়াই বলছেন, আড়তদারেরা যদি সরকারি মূল্যের চেয়েও বেশি দাম দেন, তখন চাষিকে বাধা দেওয়ার মানে চাষিরই ক্ষতি!
এই মুহূর্তে ক্রেতা-বিক্রেতাদের বড় অংশ মনে করছেন যে, বাজারের নিজস্ব লেনদেনের মধ্যে সরকার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করেই আলু নিয়ে বিপত্তি ডেকে এনেছে। এ বার ধান নিয়ে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, সেটা ভেবে শঙ্কিত তাঁরা। যদিও মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দল তা মানতে রাজি নয়। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় দাবি করেন, “ভারতে কোনও মুখ্যমন্ত্রী নেই যিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বাজার ঘুরে সব্জির মূল্যবৃদ্ধি রোধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন!”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.