অভিষেকে বাজিমাত
আগের ১৩ |
শিখর ধবন ১৮৭ অস্ট্রেলিয়া
মোহালি ২০১৩
সুরেশ রায়না ১২০ শ্রীলঙ্কা
কলম্বো ২০১০
বীরেন্দ্র সহবাগ ১০৫ দক্ষিণ আফ্রিকা
ব্লুমফন্টেন ২০০১
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ১৩১ ইংল্যান্ড
লর্ডস ১৯৯৬
প্রবীণ আমরে ১০৩ দক্ষিণ আফ্রিকা
ডারবান ১৯৯২
মহম্মদ আজহারউদ্দিন ১১০ ইংল্যান্ড
ইডেন ১৯৮৪
সুরিন্দর অমরনাথ ১২৪ নিউজিল্যান্ড
অকল্যান্ড ১৯৭৬ |
১২৭* |
গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ ১৩৭ অস্ট্রেলিয়া
কানপুর ১৯৬৯
হনুমন্ত সিংহ ১০৫ ইংল্যান্ড
দিল্লি ১৯৬৪
আব্বাস আলি বেগ ১১২ ইংল্যান্ড
ম্যাঞ্চেস্টার ১৯৫৯
কৃপাল সিংহ ১০০* নিউজিল্যান্ড
হায়দরাবাদ ১৯৫৫
দীপক শোধন ১১০ পাকিস্তান
ইডেন ১৯৫২
লালা অমরনাথ ১১৮ ইংল্যান্ড
মুম্বই ১৯৩৩ |
|
উল্লাস। শতরানের পরে রোহিত শর্মা।
বৃহস্পতিবার ইডেনে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
প্রতিপক্ষ |
*অপরাজিত |
|
বিপক্ষ অধিনায়ক হিসেবে অভ্যর্থনা করেননি। কঠোর ফিল্ড সাজিয়েছেন। সে তো খেলার অঙ্গ। প্রথম বল থেকে সচিনের জন্য কি না চন্দ্রশেখরের ফিল্ড! লান্স গিবস সেরা সময়ে যেমন টেলএন্ডারের জন্য সিলি পয়েন্ট, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, লেগ স্লিপ, স্লিপ আর শর্ট মিডউইকেট রাখতেন, তা দিয়েই আতিথেয়তা করা হল সচিনকে। ইডেন এমন স্বতস্ফূর্ত গার্ড অব অনার দিয়েছে, সবাই আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে। মুরলী বিজয়ের উইকেট পড়ায় তীব্র উল্লাস প্রকাশ করেছে, এই তো প্যাভিলিয়ন থেকে ছোট শরীরটা বেরোবে। তা ছাড়া গত ক’দিনও তাঁকে ঘিরে যা সব ঘটছে তাতে তো যে কোনও মানুষের টলে যাওয়ারই কথা। শেন শিলিংফোর্ডকে তখন গিবস হিসেবে প্রোজেক্ট করাটা অবশ্যই স্যামির নিখুঁত গেমসম্যানশিপ। বেশ করেছেন, করেছেন।
কিন্তু আউটের সিদ্ধান্তে যখন নাইজেল লং বিভ্রান্ত হলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়কের তখন বিচারপদ্ধতিকে শুদ্ধ করে দেওয়ার সুযোগ ছিল। দুসরায় আবার বিভ্রান্ত হয়ে সচিন ক্রিজে পা রেখে ব্যাট বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বল এসে লাগে পিছনের পায়ে। ডান পায়ের প্যাডের ফ্ল্যাপেরও কয়েক ইঞ্চি ওপরে। পরিষ্কার বল স্টাম্পের ওপর দিয়ে চলে যেত। অথচ মুহূর্তের চাক্ষুষ বিভ্রান্তির কবলে পড়া আম্পায়ার লং হাত তুলে দিলেন। পুষ্পক রথ থেকে ক্রিকেটদেবতার আশীর্বাদ ঝরে পড়ার কথা ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ভক্তের জন্য। নেমে এল কি না নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্ত। জীবনদীপ নিভিয়ে দিয়ে গেল গোটা কলকাতা, হয়তো বা ভারতেরও। শিলিংফোর্ডকে মারা অনবদ্য দুটো ফুলের মতো অন ড্রাইভের পাপড়ি পিষে গেল মুহূর্তে। স্কোরবোর্ডে ২৪ বলে ১০ রান। সাড়ম্বরে খুঁটিপুজোই হল। কিন্তু মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠাই থেকে গেল অসমাপ্ত। আর কি সুযোগ আসবে? ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর মধ্যে ১২০ রানে পিছিয়ে। রোহিত আর অশ্বিন যেমন ব্যাট করছেন, লিড আরও বাড়া উচিত। তৃতীয় ইনিংসে পারবে এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই চাপ সামলাতে? চার নম্বর অবধি ব্যাটিং আসবে তো ভারতের? মুম্বই থেকে কলকাতা এ দিন রাতে দেখছি সবার এক আকুল প্রশ্ন।
আগের সচিন-দৃশ্যপটটা পুরো বলা হল না। তখনও মাঠ ছাড়েননি। ইডেন দর্শক একই রকম বিহ্বল। মোবাইলে দ্রুত একটা ফোন এল। একটা টেক্সট। এসএমএসে এক লাইনের প্রশ্ন, ‘এই নাইজেল লং কোন হোটেলে উঠেছে বলতে পারেন?’ আর ফোন করছেন লেকটাউনের সেই জ্যোতিষী। ক্রিকেটজনিত পূর্বাভাস যাঁর অতীতে একাধিক বার মিলেছে। ভদ্রলোক প্রথম দিনও বলেছিলেন, “ইডেন নয়, রান হলে ওয়াংখেড়েতে হবে। সচিনের মঙ্গল সিংহ রাশিতে বসে আছে। রাহু আছে তুলায়। শনিও তাই। এটা রাজসম্মান দেবে, অতুলনীয় পারফরম্যান্স দেবে না।” এগুলো সত্যি প্রমাণিত হলেও বিশ্বাস করতে মন চায় না। এর পর যা শোনা গেল তা আরও আধিদৈবিক। ক্লাবহাউসের দোতলায় দাঁড়িয়ে আদিত্য বর্মা। শ্রীনির বিরুদ্ধে সেই জঙ্গি যুবনেতা। আদিত্য উত্তেজিত, “এর পিছনে শ্রীনির চক্রান্ত আছে। ওরা এখন সচিনকে সহ্য করতে পারছে না। বলছে পওয়ারের লোক। আমায় একটা কথা বলুন, মাঠের স্ক্রিনে ওরা এক বারও সচিনের আউটের রিপ্লে দেখাল না কেন? ওয়াংখেড়েতেও ওকে এলবিডব্লিউ দেবে। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা।”
সচিনের ক্রিকেটনিয়তি বরাবরই এমন। নিজে ভীষণ অনাটকীয় চরিত্র। কথা বলেন আস্তে। আবেগকে রাখেন সব সময় লাগামে। উচ্চকিত হন না। নিজেকে রাখতে চান রংহীন মধ্যবিত্ত।
আশ্চর্য, তাঁকে ঘিরেই বরাবর জীবনের চেয়ে বৃহদাকার সব পরিস্থিতি জন্ম নেয়। তিনি ডব্লিউ জি গ্রেস স্বপ্নেও নন যে, নাইজেল লং-কে কড়া দৃষ্টি হেনে বলবেন, ‘শোনো, লোকে তোমার আম্পায়ারিং দেখতে আসেনি। আমার ব্যাটিং দেখতে ভিড় করেছে। খেলাটা আবার চালু করো।’ কিন্তু একইসঙ্গে তিনি এমন উচ্চতার মহানায়ক, গোটা পৃথিবী ব্র্যাডম্যানের শেষ সিরিজের মতো যাঁকে এই ক’টা দিন আরও বেশি করে মাপছে। এই রকম বাজে সিদ্ধান্তে প্রতিক্রিয়া কি দেখাবেন না? আর তার পর তো ইডেনের শান্তি-শৃঙ্খলা নিয়ে টানাটানি পড়বে। দর্শক ইতিমধ্যেই গর্জন করতে শুরু করেছে। তাদের শুধু চাই সেই বারুদের ওপর একটা দেশলাই কাঠি।
এই জন্যই তিনি সচিন! বিদায়বেলায় চরম প্ররোচনার মধ্যেও প্রত্যাশিত উষ্মাটা দেখান না। বেঙ্গসরকার থেকে সৌরভ, টিম ম্যানেজার থেকে কোচ সবাই বললেন, একদম ভুল ডিসিশন। সচিন নিজে কী ভাবলেন? অনুমান করছি, এমন কিছু ভাবলেন কি না যে, ডিআরএস থাকলে আমি রক্ষা পেতাম। রিপ্লে-তে বোঝা যেত বল স্টাম্পের কতটা ওপরে ছিল। কিন্তু আমি তো নিজেই সেই পদ্ধতিকে ঢুকতে দিইনি এ দেশে। আমার রথের চাকা এত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পাংচার হল, আমি নতুন টায়ার লাগাতে দিইনি বলে। মেদিনীগ্রাসের মধ্যে তা হলে একা নাইজেল লংয়ের বিচারবুদ্ধির ভুল লেগে নেই! দায়ী তো আমি নিজেও! মাইক আথারটন লিখেছেন, ‘সচিনকে মাপা হয় সোনার মানদণ্ডে। যাকে বলা যায় গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড। সচিন নিজে একটাই মাপকাঠি ব্যবহার করেন--- ব্র্যাডম্যান স্ট্যান্ডার্ড।’ তা ব্র্যাডম্যান জীবনের শেষ টেস্টের আগের টেস্ট ম্যাচের দু’ইনিংসে করেছিলেন ৩৩ আর ১৭৩ নট আউট। লিডসের সেই সেকেন্ড ইনিংসটা যে কী দুর্দান্ত ছিল তা পঁয়ষট্টি বছর বাদেও মনে করতে পারলেন নিল হার্ভে। আনন্দবাজার-কে সে দিন ফোনে হার্ভে বলছিলেন, “সবাই ডনের ওভালের শূন্যটা মনে রেখেছে। তার ঠিক আগেই দুর্দান্ত সেঞ্চুরিটার কথাটা কেউ বলে না।”
কে জানত, পুষ্পক রথ থেকে নেমে আসা বিচারে সবসেরা ভক্তের প্রতি অবিচারের সঙ্গেই ঝরে পড়বে নতুন মুম্বইকরকে ভাবী জীবনের উজ্জ্বল অঙ্গীকার! প্রকৃতিগত ভাবে রোহিত শর্মা আর সচিন তেন্ডুলকর ঠিক ততটাই এক রকম, যতটা আইসক্রিম আর কফি। চা আর বুনো হাঁস। প্লাস্টিক আর বালি। সচিন সবচেয়ে গোছানো। রোহিত রোজ জিনিস হারান, এমনই ভুলো। আইপ্যাড, দামী মোবাইল এই সব হারান। ক্রিকেটের প্রতি মনোভাবও একেবারে অ-সচিনোচিত ছিল গোড়ায়। এক বার প্র্যাক্টিসে আসছেন অনূর্ধ্ব সতেরো মুম্বইয়ের। লোকাল ট্রেনে ওয়াংখেড়ে আসার সময় দাদর আর মাটুঙ্গা স্টেশনের মাঝে তাঁর ছোট কিটব্যাগ পড়ে যায়। যার ভেতর খেলার নানা সরঞ্জাম ছিল। ট্রায়ালে এসে রোহিত ঘোষণা করেন, অনেক কিছু সঙ্গে নেই কারণ, ব্যাগ তো পড়ে গিয়েছে। ট্রায়াল যিনি পরিচালনা করছিলেন তিনি বলেন, “পরের স্টেশনে নেমে ব্যাগের খোঁজ করোনি?” রোহিত বলেন, “না তো।” ক্রুদ্ধ কোচ তখনই তাঁকে দল থেকে বাদ দিয়ে দেন।
সে দিনের সেই শাস্তি দেওয়া কোচ এ দিন ইডেনে বসে উচ্ছ্বসিত হয়ে দেখলেন, আজকের রোহিতের দায়িত্বজ্ঞান কোন পর্যায়ে উন্নীত! সময় সময় তাঁর ড্রাইভে ভিভিএস লক্ষ্মণের ছায়াও পেলেন প্রাক্তনীরা। আবির্ভাব টেস্টেই ওই রকম চাপের মধ্যে ভারতকে যে ভঙ্গিতে টেনে নিয়ে গেলেন রোহিত, তাতে মুম্বই থেকেই পরিষ্কার নতুন ক্রিকেট জীবনের অঙ্গীকার! একটা যখন চুল্লির দিকে, আরেকটা জীবনের স্পন্দন দিচ্ছে।
পুরনো মুম্বইকর? তা তেন্ডুলকর-ঘনিষ্ঠ রাতে বান্দ্রা থেকে ফোনে বললেন, “ম্যাচের যা চেহারা, মনে হচ্ছে হাতে রইল সেই ওয়াংখেড়ের দুই!” পুষ্পক রথের বিচার কি তা-ই? শুক্রবার জানা যাবে। |