প্রবন্ধ...
ডেসিবেল মেপে আর লাভ নেই
কালীপুজোর বিসর্জনের মিছিলটা দেশপ্রিয় পার্কের কাছাকাছি এসে থেমে গেল; আর শুরু হয়ে গেল প্রবল প্রতাপে রাস্তার গাড়িঘোড়া থামিয়ে চকলেট বোমা ফাটানো। বড় রাস্তার ঠিক মাঝখানে, জনা পনেরো পুলিশের নাকের ডগায়। ‘বেআইনি শব্দবাজি সর্বসমক্ষে ফাটছে, আপনারা কী করছেন?’ বিসর্জন-মিছিলের সামনে থাকা এক পুলিশ আধিকারিককে প্রশ্ন করতেই, তিনি ‘সবই তো বোঝেন’ গোছের মুখ করে সরে গেলেন।
এমন অভিজ্ঞতা সাম্প্রতিক কালীপুজোর ভাসানের রাতে ব্যতিক্রম ছিল না। এবং সেটা এ বছরে কলকাতা পুলিশের যথেষ্ট সদর্থক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও, বিশেষ করে কালীপুজোর রাতে। পাশাপাশি অবশ্য এ কথাও বলতে হবে যে দেওয়ালি বা তার পরের দিন পুলিশের সে ভূমিকা অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। অশোকনগরে শব্দবাজির বিরোধিতা করে খুন, কলকাতার চারু মার্কেট অঞ্চলে এক শারীরিক প্রতিবন্ধী যুবকের ওপর বোমাবর্ষণ, শব্দবাজি আটকানোর জন্য যাওয়া এক পুলিশকর্মীর ওপর নিগ্রহের মতো বেশ কয়েকটি ঘটনা সেই ‘ট্রেন্ড’-এর দিকেই আঙুল দেখায়।
প্রশ্ন হল, শব্দবাজির দৌরাত্ম্য আর দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে পুলিশের তথা প্রশাসনের কড়া ভূমিকাই কি একমাত্র নিদান? নিদান, কিন্তু একমাত্র নয়। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে ও এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মূলত প্রশাসনিক উদ্যোগে শব্দকে জব্দ করার উদাহরণ দেখিয়ে অনেকে হয়তো বলবেন যে, ওটাই শব্দ জব্দ করার একমাত্র ওষুধ। কিন্তু পালটা যুক্তি, ওটা বড় জোর চটজলদি সমস্যা কমানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করতে পারে, কিন্তু কোনও মতেই শব্দ-অসুখের স্থায়ী সমাধান নয়। এবং সেই কারণেই প্রথম কয়েক বছর ম্যাজিকের মতো কাজ দিলেও পরে তা ক্রমেই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদালতের চাপ শিথিল হয়েছে; পাল্লা দিয়ে গা ছাড়া দিয়েছে দূষণ পর্ষদ, পুলিশ ও সামগ্রিক প্রশাসন। পাশাপাশি শব্দজব্দের বিরুদ্ধে বেড়েছে রাজনৈতিক ছাতার তলায় বাজি প্রস্তুতকারকদের চাপ। এটাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নতিশীল দেশে যেখানে সামাজিক সুরক্ষা, প্রশাসনের প্রয়োগ, রাজনীতির স্বার্থ হাত ধরাধরি করে চলে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, অনেকেই শব্দ করে ও শুনিয়ে আনন্দ পান।
এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দুটি ধাপ।
, সামাজিক চাপ বাড়ানো, যা প্রশাসনকে কখনওই শিথিল হতে দেবে না;
, এমন কিছু প্রশাসনিক পরিবর্তন আনা যা শব্দের সমস্যার স্থায়ী সমাধান আনবে। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী কলকাতা শহর দিল্লির পাশাপাশি একমাত্র মহানগর যেখানে গত দেওয়ালির তুলনায় শব্দদূষণ রীতিমত বেড়েছে; বস্তুত দক্ষিণ কলকাতার গোলপার্ক অঞ্চলের শব্দ মাপার যন্ত্রে সারা দেশের মধ্যে গত বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। রাত দশটায় শব্দবাজি ফাটানো বন্ধ হওয়ার কথা, কিন্তু তা যথেচ্ছ চলেছে ভোর অবধি।
শুধু শব্দ কেন, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বায়ুদূষণের মাত্রাও। মনে রাখতে হবে, শব্দ ও আলো, দু’রকম বাজির থেকেই ভয়ানক বায়ুদূষণ হয়। কতটা, তা এ বারের রাজ্য দূষণ পর্ষদের কালীপুজো ও দেওয়ালির রাতে করা বায়ুদূষণ সমীক্ষা থেকেই স্পষ্ট। পর্ষদের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বসানো স্বয়ংক্রিয় দূষণমাপক যন্ত্রের তথ্য অনুযায়ী কালীপুজোর মধ্য রাত থেকে পরের দিন ভোর চারটে অবধি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণার (সরকারি নাম পি এম অর্থাৎ পার্টিকুলেট ম্যাটার ১০) পরিমাণ প্রতি ঘনমিটার বাতাসে প্রায় ৫৫০ মাইক্রোগ্রাম ছিল; আর দেওয়ালির রাতে ১৩০০ মাইক্রোগ্রামের আশেপাশে, রাত দুটোয় ১৬০০। দেশের অনুমোদিত সীমা ১০০ মাইক্রোগ্রাম আর সাধারণত শীতকালের রাতে কলকাতা শহরের ধূলিকণা-দূষণের পরিমাণ ৩০০ মাইক্রোগ্রামের কাছাকাছি হয়। (কালীপুজোর আগের রাতেও তা ছিল) সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণার দূষণকে ক্যানসারের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে সরকারি ভাবে চিহ্নিত করেছে।
আরও ভয়ের কথা, কালীপুজো ও দেওয়ালির রাতে শব্দবাজি ও নানান রঙের আলোর বাজি পোড়ানোর ফলে যে ধোঁয়ার চাদর তৈরি হয়, তার মধ্যে সিসা, দস্তা, আর্সেনিক, অ্যালুমিনিয়াম, ইত্যাদি বিভিন্ন ভারী দূষক পদার্থ মিশে যায়, সব মিলিয়ে আরও বিষাক্ত হয়ে ওঠে শহরের বাতাস। এই সব পদার্থের ‘গুণ’-এই হাজার টাকা দামের বাজি আকাশে উঠে লাল, সবুজ, সাদা রং ছড়ায়। আমরা মনে আনন্দ পাই, নিশ্বাসে বিষ। প্রসঙ্গত, একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, বাজির ধোঁয়ায় বাড়ির পোকামাকড় মরে। পোকামাকড়ের কী হয়, সেটা পরের কথা, তবে আমরা ব্যাধি ও মৃত্যুর পথে অনেকটা করে এগিয়ে যাচ্ছি।
শব্দ ও বায়ুদূষণের ভয়ানক যুগলবন্দি একটা ভাবনা জাগাচ্ছে। শব্দবাজির সর্বোচ্চ মাপকাঠি নব্বই না একশো পঁচিশ— সেই বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসে এ বার বোধহয় এই দাবি তোলার সময় হয়েছে যে, সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে বাজি ফাটাতে হবে। যেমনটা, কেবল লন্ডন নয়, পৃথিবীর অধিকাংশ শহরেই হয়। জনবসতি থেকে যতটা সম্ভব দূরে ফাঁকা জায়গায়। যাঁরা বাজি ফাটাতে বা পোড়াতে চান, বা যাঁরা তা দেখতে চান; তাঁরা উপভোগ করুন। জনসাধারণকে, প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘ক্যাপটিভ লিস্নার্স’ হতে হয় না।
কলকাতার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে কি এমন জায়গা পাওয়া সম্ভব? সম্ভব। গঙ্গার ধারের ফাঁকা জায়গায়, বিভিন্ন বড় পার্কে, দ্বিতীয় হুগলি সেতুর তলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, এ-রকম নানা জায়গার সন্ধান করা যায়। বিভিন্ন এলাকায় ছোট মাপের ফাঁকা জায়গাও আছে। আর, যা জায়গা আছে, তার মধ্যেই উৎসবকে সীমিত রাখতে হবে। সেটাই তো সংযম, যে সংযম সভ্যতার আবশ্যিক শর্ত।
এই সংযত উৎসবের দাবিটা আসতে হবে পরিবেশবিদ এবং সমাজকর্মীদের কাছ থেকেই। এ বার কালীপুজো ও দেওয়ালির ক্ষেত্রে পরিবেশবিদদের, বিশেষ করে সবুজ সংগঠন ও কর্মীদের প্ল্যাটফর্ম ‘সবুজ মঞ্চ’র ভূমিকাই স্পষ্ট করে যে, নাগরিক সমাজের নজরদারি ও চাপ কতটা প্রয়োজন। এই চাপটুকু না থাকলে কিন্তু গ্রিন ট্রাইবুনাল-এর ১২৫ ডেসিবেল রায়কে পালটাতে সরকারকে উদ্যোগী করা কঠিন হত। রাজ্যের শব্দ আন্দোলনে যাঁরা পথ দেখিয়েছেন, প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে দূষণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইনি আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, অ্যাডভোকেট গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে কলকাতার প্রাক্তন শেরিফ চিকিৎসক দুলাল বসু, সবাই একমত যে, সারা পৃথিবীর মতো কলকাতায় তথা পশ্চিমবঙ্গে শব্দ তথা আলোর বাজি ফাটানোর সময় ও স্থান নির্দিষ্ট করার সময় এসেছে। কেবল, সবুজ মঞ্চের আহ্বায়ক নব দত্তের কথায়, আমাদের দেখতে হবে যেন জৈববৈচিত্র্যের ক্ষতি না হয়। অবশ্যই, সেটা নিশ্চিত করা পরিবেশবিদ ও প্রশাসনের দায়িত্ব। কিন্তু সাধারণ শহরবাসী হিসেবে চাইব যত দ্রুত সম্ভব ‘যখন খুশি তখন’, ‘যেখানে খুশি সেখানে’, আমার জানলার পাশে, দরজার ও পারে, পাশের ছাদে বাজি পোড়ানো বন্ধ হোক। দয়া করে আমার স্বস্তিতে বাঁচার স্বাধীনতা ও অধিকারকে মর্যাদা দিন প্রশাসন। পাশে দাঁড়ান পরিবেশবিদরা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.