কক্ষপথ ছেড়ে তীর বেগে ছুটে আসছে ৯০০ কেজির কৃত্রিম উপগ্রহ ‘গোচে’। ধরাধামের কোথায়, কখন আছড়ে পড়বে, জানা নেই কারও। ফলে মাথায় হাত বিজ্ঞানীদের! আতঙ্কিত ইউরোপ।
নিউটন সেই কবে বলে গিয়েছিলেন কোনও বস্তুকে উপরের দিকে ছুড়ে দিলে, অভিকর্ষ বলের টানে তা ফের নীচে নেমে আসবে। অথচ কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে মহাকাশযান, উৎক্ষেপণের সাফল্যে মিশন কন্ট্রোল রুমে যখন কান পাতা দায়, জয়ের আনন্দে বিজ্ঞানীরা জড়িয়ে ধরছেন একে অপরকে কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেন কি, কয়েকশো টন ওজনের যন্ত্রাংশ যদি ফিরে আসে তার নিজের ঘরে? যদি আছড়ে পড়ে পৃথিবীর ঘাড়ে? সমালোচকদের দাবি, বিজ্ঞানীরা এটা ভাবেন না। ভূরি ভূরি উদাহরণ। অকেজো মহাকাশযান বা উপগ্রহকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘স্পেস ডেবরি’ বা মহাকাশের আবর্জনা বলা হয়ে থাকে। শুধু এ বছরই অন্তত এমন ১০০ টন (অর্থাৎ গোচে-র মতো ১০০টা) আবর্জনা আকাশ থেকে ভেঙে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। এত দিন পর্যন্ত বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি ঠিকই। তবু প্রতিবারই বুক ধুকপুক করতে শুরু করে বিজ্ঞানীদের। এ বারেও তাই। কারণ অভিযানের সময় সুতোটা গবেষকদের হাতে থাকলেও, ভগ্ন-যান নিয়ন্ত্রণহীন। অনেকটা কেটে যাওয়ার ঘুড়ির মতোই। যে কোনও জায়গায় ভেঙে পড়তে পারে। ভারতে, পাকিস্তানে, পৃথিবীর যে কোনও স্থানে। মিশন ম্যানেজার রুনে ফ্লোবারগাজেনের কথায়, “বলা খুব কঠিন, কোথায় এসে পড়বে উপগ্রহের ভগ্নাংশ। এখনও পর্যন্ত আমাদের অনুমান, রবিবারই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়ছে গোচে। সোমবার মাটিতে আছড়ে পড়বে।” তবে সবটাই অনুমান।
২০০৯ সালে সফল হয় গোচে-র উৎক্ষেপণ। পৃথিবীর দুই মেরু বরাবর ছিল তার কক্ষপথ। ভূ-পরিক্রমা সারতে সময় লেগে যেত প্রায় ৮৮ মিনিট। গত মাসে যান্ত্রিক গোলযোগে অকেজো হয়ে উপগ্রহটি। বুধবার পর্যন্ত শোনা গিয়েছে পৃথিবী থেকে ১১৩ মাইল উপরে রয়েছে সে। পরের খবর আর জানা নেই। নাসার একটি কৃত্রিম উপগ্রহকে কেন্দ্র করে দু’বছর আগেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। সে বারও প্রশান্তমহাসাগরের বুকে ঝাঁপ দেওয়ার আগে পর্যন্ত টান টান উত্তেজনা, আশঙ্কায় দিন গুনেছে মানুষ।
সে বছরই, অর্থাৎ ২০১১-র শেষের দিকে মঙ্গলে যান পাঠিয়েছিল রাশিয়া। নাম ছিল ‘ফোবোস’। উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হয়। মাস কয়েক পরে মঙ্গলমুখী যান বুমেরাং হয়ে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর বুকেই। সৌভাগ্যের কথা এটুকু-ই যে, সে বারও প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পড়ে যানের ভগ্নাংশ।
স্কাই-ল্যাবের ইতিহাস এখনও জ্বলজ্যান্ত। ১৯৭৯ সালে ভেঙে পড়েছিল মার্কিন মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র, স্কাই-ল্যাব। এ ধরনের গবেষণাগারও এক রকম কৃত্রিম উপগ্রহ। স্কাই-ল্যাব ছিল ন’তলা বাড়ির সমান। ওজন প্রায় ৭৭.৫ টন বা ৭০৩০৬ কেজি। এ হেন জিনিস যদি ঘাড়ে এসে পড়ে, কী হবে? ভেবে শিউরে উঠেছিল মানুষ। মন্দির-মসজিদ-গির্জায় পুজোপাঠ শুরু হয়ে গিয়েছিল। শেষে সে বছরই ১২ জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার এসপেরান্স-এ ভেঙে পড়ে ল্যাব। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষমা চেয়ে নেন অস্ট্রেলিয়ার কাছে। যদিও থেমে থাকেনি মহাকাশ-বিপ্লব। বিপর্যয়ের নজিরও অসংখ্য। গোচে অবশ্য স্কাই-ল্যাবের তুলনায় একবারেই ছোট। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুমণ্ডল পার হওয়ার সময় হয়তো জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাবে উপগ্রহটি। হয়তো ছোট ছোট কয়েকটা টুকরা এসে পড়বে এ গ্রহের মাটিতে।
কিন্তু ক্ষুদ্র হলেও একেবারে ওজন-শূন্য তো নয়। সুতরাং তীর বেগে আসা ওই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আগন্তুকরাও যথেষ্টশক্তিশালী এবং বিপজ্জনক। |