কোথাও ১৪ জন ছাত্রপিছু এক জন শিক্ষক আবার কোথাও ৫৭ জনের জন্যও রয়েছেন এক জন। কোনও স্কুলে পড়ুয়ার তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা বেশি, আবার কোথাও নামমাত্র শিক্ষক দিয়েই চলছে স্কুল। ফলে বারবারই স্কুলে ক্লাস না হওয়া বা মিড-ডে মিল বন্ধ থাকার মতো ঘটনা ঘটছে। মন্তেশ্বর ৩ নম্বর চক্রের বহু অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলেই পড়ুয়াদের অনুপাতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমবন্টন নেই বলে অভিযোগ উঠছে। শিক্ষকের অভাবে একটি স্কুলের মিড-ডে মিল বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।
মন্তেশ্বরের মাঝেরগ্রাম, জামনা, পিপলন ও ভাগরা মূলগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা প্রাথমিক স্কুলের তিন নম্বর চক্রের আওতাধীন। মোট ৬১টি স্কুল রয়েছে এই চক্রে। এর মধ্যে বহু স্কুলেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শিক্ষক রয়েছেন। আবার কোনও কোনও স্কুলে ছাত্রছাত্রীর অনুপাতে শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই বললেই চলে। সেই সমস্ত স্কুলের শিক্ষকদের অভিযোগ, বেশি পড়ুয়া থাকা সত্ত্বেও একাধিক স্কুল চলছে মাত্র দু’জন শিক্ষককে নিয়ে। তার মধ্যে কোনও কারণে একজন না এলে পাঁচটি ক্লাসের দায়িত্ব বর্তায় এক জন শিক্ষকের উপরে। যেখানে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ৩০ জন ছাত্রছাত্রী পিছু এক জন করে শিক্ষক বা শিক্ষিকা থাকা উচিত।
ভাণ্ডারবাটি অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৪২। রয়েছেন তিন শিক্ষক। ভেলিয়া অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলে ৫৬ জন ছাত্রছাত্রীকে পড়ান চার জন শিক্ষক। কাটসিহি অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়া সংখ্যা ৮৪, শিক্ষক রয়েছেন পাঁচ জন। জামনা বালিকা প্রাথমিক স্কুলে ৫৩ জনের জন্য রয়েছেন তিন শিক্ষক। অর্থাৎ গড়ে ১৬ জন ছাত্রছাত্রী পিছু একজন করে শিক্ষক রয়েছেন এই স্কুলগুলিতে। পাশাপাশি, উজনা অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলে ৮৬ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য রয়েছেন ২ শিক্ষক। সিজনা অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলে ১১৬ জনের রয়েছেন ২ জন শিক্ষক। |
তাজপুর অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলে ১১০ জনের জন্যও রয়েছেন ২ জন। বরণডালা অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলের হাল তো আরও খারাপ। ৯১ জন পড়ুয়া থাকলেও শিক্ষক মাত্র এক জন। খোড়দা-ইশনা স্কুলে আবার ৮৭ জনের জন্য রয়েছেন ২ জন। কুলে নিউ অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলে ৯৯ জনের জন্য রয়েছেন ২ জন শিক্ষক। অর্থাৎ এই সমস্ত স্কুলগুলিতে ৫৭ জন ছাত্রপিছু এক জন করে শিক্ষক রয়েছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, মন্তেশ্বরের একটি চক্রের মধ্যেই বেশ কিছু স্কুলে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক সংখ্যা বেশি, আবার কিছু স্কুলে শিক্ষক না থাকায় ক্লাস চালানোই মুশকিল হয়ে পড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই চক্রের কয়েকজন শিক্ষকেরও অভিযোগ, “ছাত্রছাত্রী অনুপাতে শিক্ষক শিক্ষিকাদের সমবণ্টন না থাকায় পঠন-পাঠনে অসুবিধে হচ্ছে। যে সমস্ত স্কুলে দু’জন শিক্ষক রয়েছেন সেখানে একজন না এলে অন্য জনের পক্ষে মিড-ডে মিল ও ক্লাস চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।”
একজন মাত্র স্থায়ী শিক্ষক থাকায় সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে বরণডালা অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, একজন শিক্ষক থাকায় স্কুলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাও তোলা যাচ্ছে না। ফলে পুজোর সময় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নতুন পোশাক কেনার সরকারি টাকা আসলেও তা বিলি করা যায়নি। টাকার টানাটানিতে ২৮ অক্টোবর থেকে মিড-ডে মিলও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তথা একমাত্র স্থায়ী শিক্ষক সুকান্ত রুদ্র জানান, স্কুলে সঞ্জয়কুমার ঘোষ নামে আরও একজন স্থায়ী শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু ২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সঞ্জয়বাবু টেলিফোনে জানিয়ে দেন তাঁর শরীর অসুস্থ। এরপর থেকে আর স্কুলে আসেননি তিনি। তবে এ বছরের নভেম্বরে কাটসিহি জুনিয়র বেসিক স্কুলের শিক্ষক পার্থসারথি সরকারকে অস্থায়ী ভাবে স্কুলে পাঠানো হয়। সুকান্তবাবুর কথায়, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে একটি নতুন নির্দেশিকা আসে। তাতে বলা হয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে স্কুলের টাকা তুলতে গেলে প্রধান শিক্ষক ও আরও একজন শিক্ষিকা অথবা শিক্ষিকা না থাকলে অন্য একজন শিক্ষকের স্বাক্ষর প্রয়োজন। যেহেতু স্কুলে তিনিই একমাত্র শিক্ষক, তাই তাঁর পক্ষে সরকারি টাকা খরচ করা সম্ভব হচ্ছে না। সমস্যার কথা ইতিমধ্যেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি, সমস্যা মিটে যাবে এই আশায় মিড-ডে মিল রান্নার জন্য মুদির দোকান থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার হয়ে গেছে। যাঁরা মিড-ডে মিল রান্না করেন তাঁদের চার মাসের বেতনও বাকি। এই পরিস্থিতিতে মুদির দোকান থেকেও আর ধার মিলছে না। তাই মিড-ডে মিল বন্ধ রাখা হয়েছে।
সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন মন্তেশ্বর ৩ চক্রের অবর স্কুল পরিদর্শক সৌমেন সরকারও। তিনি বলেন, “ছাত্রছাত্রীর অনুপাতে শিক্ষক না থাকার বিষয়টি শিক্ষক সংগঠনগুলির সঙ্গে বসে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে।” তাঁর আশ্বাস, “বরণডালা প্রাথমিক স্কুলে দ্রুত মিড-ডে মিল চালু করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। স্কুলটিতে একজন স্থায়ী শিক্ষক পাঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।” |