...আসবে কত ক্ষণ
রূপা মণ্ডল
কলকাতা
হালয়ার দিন থেকেই আমার মনে হয় পুজো শুরু হয়ে গেল। ব্রাহ্মমুহূর্তে আকাশবাণী কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় চণ্ডীপাঠ ও বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে সঙ্গীত মূর্ছনা না শুনলে জীবনটাই বৃথা মনে হয়। পুজোর দিন কয়েক আগে অফিস যাওয়ার পথে যখন দেখি কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে অথবা কোনও বাড়ির ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন মনের খুশি খুশি ভাবটা উপচে ওঠে। রাস্তায় কাঠের খুঁটি পথকে সংকীর্ণ করে তোলে। যান চলাচলের বড়ই অসুবিধা। তবু মনে হয় এ তো আর সারা বছর নয়, এই ক’দিন না হয় একটু কষ্টই করলাম। সে কষ্টের মধ্যেও তো আনন্দ আছে। পুজোর দিনগুলিতে শহর কলকাতায় শুধু ধোঁয়া-ধুলো-দূষণ সরিয়ে প্রাণের সঞ্চার হয়।
তার পর দেখতে দেখতে আসে মহাষষ্ঠীর ভোর, মায়ের বোধন হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অফিসে যাই। কাজে মন বসে না। ওই বুঝি ঢাকে পড়ল কাঠি। বার বার ঘড়িতে চোখ রাখি। সময় যে আর কাটে না। সে দিন ঘড়িটা যেন ইচ্ছা করে দেরিতে চলে। অফিসে কাজের চাপ নেই। সবাই ছুটির অপেক্ষা করে। হাসি-মজা-গল্পে দিনটা কেটে যায়। ছুটির পরে ভিড়ে ভরা পথ চলতে চলতে দেখি কত লোকজন, মেয়েরা, বাচ্চারা নতুন জামাকাপড় পরে সদলবল ঠাকুর দেখছে। অধৈর্য হয়ে উঠি কখন বাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোব, এই ভেবে। বাড়ি ফিরেই বেরিয়ে পড়ি। পাড়ার ঠাকুর যতগুলো দেখে নেওয়া যায় আর কি! ব্যতিক্রম হয়নি এ বছরেও। রাত সাড়ে আটটায় বাড়ি পৌঁছলাম। আমাদের পাশের বাড়িতেই দুর্গাপুজো হয়। প্রথমেই গেলাম সেখানে। দুর্গার হাতে তখন অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হচ্ছে। সেখানে কিছু ক্ষণ বসে থাকার পর অন্য আরও তিনটে প্যান্ডেলে গেলাম। বেশির ভাগ জায়গাতেই তখন কোথাও ঠাকুরের হাতে অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে তো কোথাও পরানো হচ্ছে রুপোর মুকুট (পুরনো পুজোয়)। সে দিন শরীর আর বইছিল না, তাই বাড়ি ফিরে এলাম।

পর দিন সকালে ঘুম ভাঙল ঢাকের আওয়াজে। মেয়ের জন্য নতুন জামা বের করেই রেখেছিলাম। মুখ ধুয়েই সে ছুটল পুজোমণ্ডপে। আমি ঘরের কাজে ব্যস্ত হলাম। হঠাৎ ঢাকের আওয়াজে বুঝলাম কলা বৌ স্নান করতে চলেছে গঙ্গায়। আমিও চন্দন বাটতে ও সিঁদুর গুলতে শুরু করে দিলাম। বহু দিনের রীতি এটা। কলা বৌ স্নান করতে গেলেই বাড়ির প্রত্যেকটি দরজায় সিঁদুর ও চন্দনের ফোঁটা লাগাতে হবে। আমার ঠাকুমার আমল থেকে বা তারও আগে থেকে চলে আসছে এই নিয়ম। সপ্তমীর দিন সকালে বাড়ির কাজকর্ম সেরে, স্নান করে নতুন শাড়ি পরে মণ্ডপে হাজির হলাম। তখন পুজো হচ্ছে। আরতি দেখে বাড়ি ফিরলাম। দুপুরে পিসিমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল।

অষ্টমীর দিন সকালে প্রথমেই স্নান করে অঞ্জলি দিলাম—
ওঁ জয়ন্তি মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী
দুর্গা শিব ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তুতে
এষ সচন্দনগন্ধপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি, ওঁ হী্রং দুর্গায়ৈ নমঃ॥

এ বছরে বিকেল তিনটে বেজে আটচল্লিশ মিনিট থেকে সন্ধিপুজো ছিল। চারটের পরই প্রথমে গুঁড়িগুঁড়ি, তার পরে জোর বৃষ্টি শুরু হল। সেই সঙ্গে একটু ঝড়। আমরা তখন পাশের বাড়ির উঠোনে বসে সন্ধিপুজো দেখছি। সবাই তাড়াহুড়ো শুরু করে দিল প্যান্ডেলের ভিতর সরে আসার জন্য। প্রথমে একটু জোরে হলেও ক্রমে ঝড়বৃষ্টির প্রতাপ কমে এল। নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল সন্ধিপুজো। আকাশের মুখ ভার কিন্তু কমল না। দফায় দফায় বৃষ্টি এসে ঠাকুর দেখা বন্ধ করে দিল। তবু কিছুটা ঘুরে এলাম। কোথাও থিম উত্তরাখণ্ডের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির কোথাও বা টাকার নেশায় দৌড়নো মানুষের ক্রমশ উপরে ওঠার নেশা, কোনওখানে পড়ার চাপে হারিয়ে যাওয়া শৈশব— সমস্তই সুন্দর। ভাবনায় নতুনত্বের ছাপ।

নবমীর দিন সকালবেলায় মনে হচ্ছিল আকাশ বুঝি পরিষ্কার হয়ে গেল, কেটে গেল মেঘ! কিন্তু দুপুর থেকে ফের বৃষ্টি। দফায় দফায় এবং মুষলধারে। তবু সন্ধ্যাবেলায় ছাতা হাতে ঠাকুর দেখতে ছাড়িনি। আড়িয়াদহের প্রগতি সংঘে এ বারের থিম ছিল গুহার ভিতরে মা দুর্গা সপরিবারে ঝর্নার জলে স্নান করছেন। হাতে কোনও অস্ত্র নেই, শুধু দশ হাতে দশটা পদ্মফুল। বড় চমৎকার লাগল। ডানলপে অশোকগড়ে ঘাস দিয়ে প্যান্ডেল খুব অভিনব মনে হল। বিবেকানন্দ সেবা সমিতির প্যান্ডেল হয়েছে কেদারনাথ মন্দিরের অনুকরণে। সেখানে ঠাকুরের গায়ের রং বরফ সাদা। সোনালি সিনেমা হলের সামনের ঠাকুর বরাবরই সুন্দর হয়, এ বছরও তাই হয়েছে। সিঁথির মোড়ের ঠাকুর এবং প্যান্ডেলের অভিনবত্বও অসাধারণ। সেখানকার থিম মুখোশের আড়ালে মানুষ। বৃষ্টির কারণে এ বারে ঠাকুর দেখা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হল।

দশমীর দিন সকাল থেকেই সেই চিরাচরিত মন খারাপের পালা। ঠাকুর বড্ড কম সময়ের জন্য আসেন। বিকেলের মধ্যে কাছাকাছি প্রায় সমস্ত প্যান্ডেলের ঠাকুরের বিসর্জন হয়ে গেল। স্থানীয় কেবল চ্যানেলে গঙ্গার ঘাট থেকে বিসর্জনের ‘লাইভ টেলিকাস্ট’ করল। প্যান্ডেলের মধ্যে পড়ে রইল ঠাকুরের চালচিত্র আর জ্বলন্ত প্রদীপখানি।
শুভ বিজয়া!
 



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.