বৃষ্টিভেজা দুগ্গাপুজো
মধুমিতা দে
কলকাতা
ই রোদ এই বৃষ্টি। যখন তখন মেঘের মন খারাপ। ভরদুপুরে গাঢ় সন্ধের আঁধার। বজ্রবিদ্যুতের ঝিলিক ও এলোপাথাড়ি হাওয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহর। প্রকৃতির উন্মুক্ত আঁচলে ভিন্ন শরতের পদার্পণ। রেললাইনের ধারে বৃষ্টিভেজা গুটিকয় কাশের ঝোপ ও পাশের বাড়ির উঠোন জুড়ে শিউলির আলপনা তবুও বাতাসের বুকে লিখতে শুরু করল শারদ উৎসবের সুগন্ধময় খোলা চিঠি।

বর্ষাবাদলের হাজারো ঝক্কি সামলে কাঁচা মাটির শরীরে ছড়িয়ে পড়ল রামধনু রঙের পরশ। জল জমা মাঠে অর্ধসমাপ্ত মণ্ডপের গায়ে গায়ে শিল্পের নিদর্শন। শুরু হল বাতাসের তরঙ্গে ‘মা’র সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা— ‘কবে আসবে মা? কবে? আর যে দেরি সয় না।’ পুবের আকাশে মৃদু রক্তিম আভায় শীতল মহালয়ার ভোর মুখরিত হল আকুল প্রার্থনায়, ‘জাগো, জাগো মা’। এই অনবদ্য অলৌকিক মুহূর্তটি অতিক্রান্ত হলেই বার বার মনে হয় কে যেন ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। মরীচিকাময় চাওয়া পাওয়া ও প্লাস্টিক স্মাইলে বন্দি হিসেবি দাবার গুটির মতো জীবন ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছে কোনও এক অদৃশ্য জীবনীশক্তি।

মুদ্রাস্ফীতির জেরে যদিও এ বার বাজার দর বেশ চড়া তবুও ‘উইন্ডো শপিং’-এ কি মন ভরে! গড়িয়াহাট, সাউথসিটি, ওয়েস্ট সাইড ও নিউমার্কেটের ভিড়ে কাছের মানুষজনের অনুচ্চারিত আবদার মেটাতে আমিও উজাড় করলাম মন ও ব্যাগ। বার বার মনে পড়ল ঠাকুমা, দিদা, দাদুদের কাছে আবদার করে পাওয়া কাচের চুড়ি ও লম্বাবেণীওয়ালা ব্যাগের মধ্যে খুচরো পয়সায় ‘ঝনঝন’ শব্দ। আজ অনেক আবদার পূরণের সামর্থ্য থাকলেও কোথায় হারিয়ে গিয়েছে সেই সব মানুষজন।

রকমারি বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং ও আলোর চাঁদোয়া মুড়ে প্রস্তুত কলকাতা। এ বছর চতুর্থী থেকেই জনস্রোত সামিল হয়েছে ‘প্যান্ডেল হপিং’-এ। পঞ্চমী ও ষষ্ঠীর সন্ধেতে অফিস ফেরত বান্ধবীদের সঙ্গে ট্রাফিক জ্যামে ফেঁসে, ঘেমে নেয়ে শেষবেলার কেনাকাটি ও পাল্লা দিয়ে ফুচকা খেতে খেতে হারিয়ে গেলাম ছেলেবেলায়, পায়ে পায়ে নস্টালজিয়ায়। কর্মসূত্রে বেশির ভাগ ‘তুতো’ ভাইবোনেরা, বন্ধুরা দেশের বাইরে। হাপিত্যেশ করে বসে থাকি কবে পুজো আসবে, ওরা আসবে। ই-মেল, ফেসবুকের ঝাঁপি ফেলে খোলা আকাশের নীচে মন ভাসাব অন্তরের টানে। বেজে উঠল মোবাইল— সুবর্ণ হাতছানি।

কারডিফ থেকে আসা মাসতুতো দাদা-বৌদির নিমন্ত্রণে কলকাতার ভাইবোনেরা হুল্লোড় করে সপ্তমীর সকালে পৌঁছে গেলাম সাউথসিটিতে। জমজমাট ভিড়। টুকটাক উপহার বিনিময়ের পালা শেষ করে চাইনিজ ও দেদার আড্ডায় জমে গেল উৎসবের আমেজ। তার পর হেঁটে হেঁটে ঘুরলাম যোধপুর পার্ক, তালতলা, সেলিমপুর, পঁচানব্বই পল্লি। দাদার পুঁচকে দুই ছেলে তো এখানকার পুজো দেখে হতবাক। জনস্রোতের আবেগে আপ্লুত নগরী রাত পেরোল মহাষ্টমীতে।

ভোর থেকেই মেঘলা আকাশ, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। টেলিভিশন জুড়ে সতর্কবার্তা। ওড়িশার সমুদ্র উপকূলে ‘পিলিন’ নামক ঘূর্ণিঝড়ের আবির্ভাবে কলকাতার বুক জুড়ে তখন বইছে সামুদ্রিক হাওয়া, প্রতি বারের মতো এ বারও নতুন শাড়ি পরে পাড়ায় কাকিমা, জেঠিমাদের সঙ্গে হাত লাগালাম পুজো প্রস্তুতিতে। এর পর এল পুষ্পাঞ্জলির বিশেষ আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। ঢাকের উল্লাস, মন্ত্রোচ্চারণ, চন্দন, কর্পূর, ধুনোর সুগন্ধিত ধোঁয়ায় দেবীর স্বর্গীয় রূপে ডুবে যেতে যেতে মনে হয় আমার রক্তমাংসে গড়া মা ও দুগ্গা মা যেন এক ও অবিচ্ছেদ্য। এই না হলে পুজোর প্রাপ্তি। ‘মা’-এর দেওয়া উপহার। পঞ্চপ্রদীপের উত্তাপ মেখে মায়ের চরণে আকুল প্রার্থনা করি হৃদয়ের শৈত্য দূর করে আলোর তাপ ভরে দিতে। পুজো শেষে পাড়াসুদ্ধ সবাই তখন ভোগের পোলাও, আলুরদমের জন্য ব্যস্ত, ধেয়ে এল পাগলা হাওয়া ও দফায় দফায় বৃষ্টি। মনের মাঝে আনন্দ-সূর্যটাও লুকিয়ে পড়ল আশঙ্কার আড়ালে। তড়িঘড়ি ভোগ গ্রহণ পর্ব শেষে আপাদমস্তক ভিজে ফিরে এলাম বাড়িতে। এ বছর বিকেল বিকেল শুরু হল সন্ধিপুজো। ঝড় বাদলের দৌলতে মণ্ডপে বসেই পুজোর আঁচ মেখে নিতে জমলো ভিড়। যজ্ঞের আগুনে প্রজ্জ্বলিত ত্রিনয়নীর শক্তি অন্তরাত্মায় স্পষ্ট হল লাল টুকটুকে পদচিহ্নে। ঘণ্টা ও শঙ্খধ্বনিতে দেবীর প্রাণ সঞ্চারিত হল মৃত্তিকার অভ্যন্তরে। প্রাঙ্গণমঞ্চে অনুষ্ঠিত হল ছোটদের নৃত্যানুষ্ঠান, মিউজিক্যাল চেয়ার ও বড়দের ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা। এর পর আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করল না। টেলিভিশনের পর্দায় আটকে গেল চোখ পিলিনের তাণ্ডব, বিশাল সমুদ্রোচ্ছ্বাস ও ভয়ঙ্কর ক্ষয়ক্ষতিতে বিধ্বস্ত ওড়িশা উপকূলের সংবাদে।

ছুটির আমেজ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম নবমীর সকালে। দেরি করে চা-জলখাবারের ফাঁকে ফাঁকে ‘এবিপি আনন্দ’র সুবাদে ভিনদেশি শরতের হাওয়া উঁকি মারল আমাদের ড্রয়িংরুমে। সুইজারল্যান্ড, স্লাও ও সিঙ্গাপুরের উৎসবে মাতোয়ারা বাঙালি জীবনের হৃদ্যতা ছুঁয়ে গেল মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা আত্মীয়তার বন্ধন। এর পর প্রিয় পূজাবার্ষিকীর নতুন গন্ধে আচ্ছন্ন হল মন। পাড়ার ক্লাবে নারকেল দিয়ে মুগডাল, বেগুনি, মাছের কালিয়া ও চাটনি খেতে খেতে বার বার মনে পড়তে লাগল দুর্যোগের কবলে আটকে থাকা অসহায় মানুষগুলোর কথা। পিলিনের দাপটে দুপুর থেকেই ঘোর অন্ধকার ও মুষলধারায় বৃদ্ধি। অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত মন। অবশেষে বহু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি শিল্প নিদর্শনের টানে সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে বাড়িসুদ্ধ সবাই ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়লাম। একডালিয়া ও সিংহীপার্কের ঠাকুর যেই না ভালয় ভালয় দেখা শেষ করেছি আবার হানা দিল হাওয়া ও বৃষ্টি। কিন্তু থমকে নেই ভিড়। চারিদিকে এগিয়ে চলল হাজার হাজার রংবেরঙের ছাতা, পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে। হিন্দুস্থান পার্কে পুরনো মন্দিরের আদলে তৈরি অসাধারণ মণ্ডপ দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে সজোরে আছাড় খেলাম কাদামাটিতে। ঘরে বাইরের অনেক হাসাহাসি নির্দ্বিধায় সহ্য করে সেই নতুন বেশ নিয়েই মুগ্ধনয়নে দেখলাম ‘ত্রিধারার’ অপূর্ব মূর্তি ও মণ্ডপ, ‘বাদামতলা’র স্বপ্নময় পরিবেশ, ‘৬৬ পল্লি’র থিমে নারীশক্তির জয়গান। ছাতার আড়ালে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর রেস্তোরাঁতে রাতের খাওয়া সেরে, জলকাদা ডিঙিয়ে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীর ঢলে পড়ল ঘুমের দেশে।

ঝলমলে আকাশ। বিজয়া দশমী। বিদায় বেলায় একটু অন্য রকম উৎসবের আমেজ কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট চত্বরে। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য তুলে দিলাম। দুর্গোৎসবের অঢেল ব্যবস্থাপনা ও আলোর নীচে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার মুখগুলোর কাছে সাদামাঠা ভাত, ডাল, তরকারি যেন পরমান্ন। চোখের সামনে এই অসহায় মানুষগুলোকে প্রাণভরে খেতে দেখে ভরে গেল মনের আনাচকানাচ। বিষাদগ্রস্ত শূন্যতার সৌন্দর্য গায়ে মেখে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সিঁদুর খেলার ভিড়। বরণডালায় সাজানো পান, সিঁদুর, মায়ের গালে ছোঁয়াতেই অঝোর অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে এল চার দিক। মনে হল যেন আমার বড় আপনার জন নির্বাক প্রেমে নিমজ্জিত করে সুদূর পরপারে বিদায়ের জন্য প্রস্তুত। হৃদয় বিদারক যন্ত্রণা সয়ে বিদায় দিতেই হল মায়ের মূর্তিকে। ‘আসছে বছর আবার হবে’ ছন্দে একে একে মাতৃমূর্তি এগিয়ে চলল গঙ্গা পেরিয়ে আপন ঘরসংসারে। ছুটির ঘণ্টা শেষ। মন-মস্তিষ্ক জুড়ে শক্তিরূপিণীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত চেতনার উন্মেষে শুরু হল জীবনযজ্ঞের আয়োজন। ব্যক্তিগত, প্রকৃতিগত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে আমার কলকাতা প্রমাণ করে দিল সে আজও মহামিলন চরিতার্থ করতে সক্ষম। শরীর জুড়ে মায়ের সস্নেহ আলিঙ্গনের উষ্ণতায় শুরু হল অপেক্ষা, একান্ত কথোপকথন—
তুমি জেগে ওঠো মা দুনয়নে
দাও তেজদীপ্তির ছোঁয়া মরমে।
এস অনিঃশেষ প্রেম হয়ে পরাণে
হোক সার্থক এ জীবন আত্মবলিদানে।
 



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.