মাতৃভূমি কি একটাই!
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য
মন্ট্রিল, কানাডা
রদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুঙ্গভদ্রার তীরে উপন্যাসের একটা কথা আমার খুব প্রিয়— মাতৃভূমি বলে কোনও নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হয় না। মানুষের সহজাত সংস্কৃতির কেন্দ্র যেখানে, মাতৃভূমিও সেখানে। বাক্যটির সম্যক অর্থ অল্প বয়সে একটুও মাথায় ঢোকেনি, লেখক মহোদয় ধরাধামে বর্তমান থাকলে, চিঠিফিঠি লিখে নিশ্চয়ই একটা তর্ক বাধাবার তাল করতাম! আজও বুঝতাম কিনা সন্দেহ আছে যদি না জীবন ঘাড় ধরে বোঝাতো!

এই লেখা লিখতে বসে যে কথাটা কিছুতেই ভাবব না ঠিক করেছি, ঠিক সেটাই সারা ঘর জুড়ে গুনগুন করছে। ১২ হাজার কিলোমিটার দূরের সেই শহরটাকে বাড়ি বলবার অধিকার আদৌ আমার আর আছে কি? বাবা-মা না থাকলে সব কিছু কী রকম প্রাণহীন হয়ে যায়, কলকাতা আমাকে আর সে ভাবে টানে না তাই। অন্তত এ রকম কিছু একটা ভাবাই তো ভাল! কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভেতরের সেই অসাড় করে দেওয়া যন্ত্রণাটাকে তো ভুলে থাকা যায়!

তা বলে মন্ট্রিল আমার কাছে কলকাতার অল্টারনেটিভ নয় কিন্তু! কোনও ভাবেই নয়! ভালবাসার মতো প্রিয় জায়গারও কোনও বিকল্প হয় না। মন্ট্রিলের পুজোটাও তাই শুধুমাত্র কলকাতাকে ছুঁয়ে দেখবার আবেগের ছায়ায় ঢাকা নয়। কোনও ভাবেই নয়! বছর তিনেক হল এই পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছি দু’জনে, ময়ূখ আর আমি। বিদেশে পড়তে এসেছিলাম এক সঙ্গে। ভাল করে বোঝবার আগেই দেখলাম কি করে যেন এই শহরটা আর তার কিছু মানুষ বড় আপন হয়ে গিয়েছে।

শরতের আকাশটার এমন একটা পাগলামি আছে! আকুল করে দেওয়া মন খারাপ আর ফুরফুরে নীল খামখেয়ালি খুশি হাত ধরাধরি করে চলে আর ফিকফিক করে হাসে। ল্যাবে পাগলের মতো কাজ থাকে, তাই ফেসবুকে শুভ মহালয়া স্ট্যাটাস থেকে বুঝতে পারি দেবীপক্ষ পড়ে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে একটা অপূর্ব বদল আসে চারপাশটায়। ভোর হতেই মা ঘুম থেকে তুলে দিত! আজকেই তো! হলই বা দেশে এখন মাঝরাত! গোধূলিবেলায় মন্ট্রিলের কোনও এক অ্যাপার্টমেন্টে গমগম করে ওঠেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বাবা-মায়ের হাসি হাসি মুখ ছবি থেকে বলে ওঠে, ‘এই তো, আমাদের ভাললাগাগুলো নিজের ভেতর ধরে রেখেছিস কী রকম। আর কী চাই।’ কে বলে মাতৃভূমি একটাই!

চুপিচুপি আর একটা কথা বলি? ভেবেছিলাম নতুন জামা পেয়ে নেচে ওঠবার বয়স তো আমার বহুকাল গত, কী বা হবে আর সে সব কথা মনে করে। কিন্তু আসল সময়ে দেখলাম, প্রিয়জনের আদর মাখা সালোয়ারটা হাতে নিতে বেশ লাগল কিন্তু! হু হু করে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি সেটা একেবারেই টের পেলাম না।

এ বার আমাদের, মানে ‘ইন্ডিয়ান বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ মন্ট্রি়ল’-এর পুজো অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে, থ্যাঙ্কস গিভিং-এর ছুটিটা কাজে লাগিয়ে। সকালটা কেটে যায় পুরোহিতমশাইয়ের পাশে পাশে। ভট্টাচার্য হওয়ার সংস্কার বশে নয়, পুজোর কাজ ছোট্ট থেকে করতেই ভাল লাগে বলে। পুরোহিতমশাইয়ের স্নেহসিঞ্চিত বকুনিটাও বছরে তো এই একবারই জোটে। কে বলে মাতৃভূমি একটাই!

বন্ধু-বান্ধব, খাওয়াদাওয়া, বঙ্গীয় আড্ডা তো থাকবেই। কিন্তু পুজোর আগের ক’টা দিন আমাদের সাংঘাতিক ভাল কাটে। নাটকের রিহার্সাল বলে একটি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে হইহই, পার্ট মুখস্ত করা, খুনসুটি ছাড়া ভাবাই যায় না আমাদের পুজোকে। বিচ্ছিরি ফাঁকা আর একঘেয়ে হয়ে যায় পুজো পরবর্তী রুটিনটা এই রিহার্সাল বিহনে।

আর দশমীর দিন সিঁদুর খেলার সঙ্গে সঙ্গে গলা ব্যথা করা সেই অদ্ভুত কষ্টটার কথা মনে পড়ে? মায়ের মুখের বিষণ্ণতায় মিশে যায় কলকাতা, মন্ট্রিল। আর, কোনও দিন কি পালটাবে চোখের জলকে জোর করে ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়ার সেই চিরকালীন অনুভূতিটা? কে বলে মাতৃভূমি একটাই!
 



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.