কোচবিহারের মাথাভাঙার বাসিন্দা ভবেন বর্মনের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুই দফায় রক্তেরও প্রয়োজন হয়েছে। স্ত্রী সুমিত্রা দেবীকে নিয়ে দিনভর ভবেনবাবুর ঠিকানা এখন মেডিক্যাল কলেজ চত্বর। কিন্তু একটু জিরিয়ে নেওয়ার একদন্ড জায়গাও নেই। বাধ্য হয়ে গাছের তলায় খবরের কাগজ মাটিতে পেতে স্ত্রীকে নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে ভবেনবাবুকে। আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় সন্ধ্যার পর ভরসা মেডিক্যালের করিডর। বসা, খাওয়া সবই ওই দুই জায়গায়। একই অবস্থায় কার্শিয়াঙের বাসিন্দা প্রেম গুরুঙ্গের। তাঁরও রোগীও গত চারদিন ধরে মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন। রাতে কোনওমতে শিলিগুড়ির প্রধাননগরের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে মাথা গুঁজে থাকলেও দিনভর করিডর, গাছতলা, বারান্দায় একইভাবে বসে, শুইয়ে বসে থাকেন প্রেমবাবু। |
মেডিক্যালের কলেজের এই ছবি বছরের পর বছরের। সরকারিভাবে চত্বরে একটি ছোট্ট প্রতীক্ষালয় রয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, হাসপাতালের মূল ভবনের দিকে যাওয়ার রাস্তার বাঁ দিকের ওই প্রতীক্ষালয়টি কার্যত দখল করেছে রেখে ভবঘুরেদের দল। দিনভর তারাই সেখানে শুয়ে থাকায় বসার কোনও জায়গা মেলে না। দুটি শৌচালয় সেখানে বন্ধই থাকে। অনেক সময় কিছু যুবককে সেখানে বসে তাস খেলতেও দেখা যায়।
প্রতীক্ষালয়ের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় দিনের বেলায় রোগীর আত্মীয়দের তাই গাছতলা, বারান্দায়, করিডরে বসে থাকতে হচ্ছে। রাতে চত্বরের মধ্যে দুই জায়গায় থাকার ব্যবস্থা থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম বলেই বাসিন্দাদের বক্তব্য। এর মধ্যে মেডিক্যাল কলেজের নিবাসে মেরে কেটে ২০ জন এবং মহকুমা পরিষদের ভবনে ৩০ জন থাকতে পারেন। রোগীর আত্মীয়েরা জানান, সারা বছর সবাই চত্বরের বিভিন্ন এলাকায় বসে থাকেন। বৃষ্টি এবং প্রচণ্ড গরমের সময় সমস্যা বাড়ে। একই অবস্থা দাঁড়ায় শীতের সময়ও। প্রতীক্ষায়ের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে খুব একটা লাভ হয়নি।
সরকারি সূত্রের খবর, সম্প্রতি সমস্যার কথা পৌঁছায় রাজ্যের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা মেডিক্যাল কলেজের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান গৌতম দেবের কাছে। ইতিমধ্যে কয়েক দফায় বৈঠকের পর ঠিক করা হয় অত্যাধুনিক প্রতীক্ষালয় তৈরি করা হবে। গত সোমবার রোগী কল্যাণ বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতমবাবু বলেন, “রোগীর পরিবারের লোকজন বহু দূর দূরান্ত থেকে এখানে আসেন। সত্যিই ঠিকঠাক বসার ব্যবস্থাও নেই মেডিক্যাল কলেজে। তাদের অসুবিধার কথা বুঝি। তাই প্রতীক্ষালয় তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুত কাজ শুরু হয়ে যাবে।”
মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর, দুটি দোতলা প্রতীক্ষালয় তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় একটি দোতলা ভবন তৈরি হবে। আপাতত শোওয়ার ব্যবস্থা না করা হলেও তাতে ২০০ জনের বসার ব্যবস্থা থাকবে। বড় বড় হলঘরে লাগানো থাকবে স্থায়ী চেয়ার। পানীয় জল, শৌচাগার ছাড়াও সময় কাটানোর জন্য থাকবে টেলিভিশন। এরজন্য সাংসদ তহবিলের ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করা হবে। পূর্ত দফতর ওই কাজ করবে। পরের দফায় একইভাবে আরেকটি ভবন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর থেকে এরজন্য ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হবে। মন্ত্রী গৌতমবাবু বলেন, “দুই দফায় ১ কোটি টাকা খরচ করে ওই প্রতীক্ষালয়গুলি তৈরি করা হচ্ছে। বয়স্ক মানুষদের ওঠানামার কথা ভেবে ভবনগুলি দোতলার বেশি উঁচু করা হচ্ছে না।”
১৯৬৮ সালে তৈরি পর ১৯৭৮ সালে এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মেডিক্যাল কাউন্সিলের অনুমোদন পায়। উত্তরবঙ্গের ছয় জেলার পাশাপাশি সিকিম, নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশ থেকেও রোগীরা এখানে চিকিৎসার জন্য আসেন। গনে প্রতিদিন ১৬০০-১৮০০ জন রোগী মেডিক্যাল কলেজের বর্হিবিভাগের চিকিৎসার জন্য আসেন। সেখানে গড়ে ১২০০ রোগীর চিকিৎসা হয় ভর্তি রেখে। ইতিমধ্যে মেডিক্যাল কলেজের শয্যা সংখ্যাও ৫৯৯ থেকে বাড়িয়ে ৯১৭টি করার অনুমোদন মিলেছে বলে মেডিক্যাল কলেজের সুপার সব্যসাচী দাস জানিয়েছেন। |