জনমতকে ভয় পায় কে? যে জনতন্ত্রকে ভয় পায়। জনমতকে ভয় পাইলে জনমত-সমীক্ষাকেও ভয় পাইতে হয়। বিশেষ করিয়া তাহা যদি হয় প্রাকনির্বাচনী সমীক্ষা। কেননা সে ধরনের সমীক্ষায় জনমত কোন দিকে বহিতেছে, তাহার একটা পূর্বাভাস মেলে। সেই পূর্বাভাস আবার ভোটদাতাদের প্রভাবিত করিতে পারে। তাঁহারা ভাবিতে পারেন, যে-দল জিতিবে না, তাহাকে মিছামিছি ভোট দেওয়া কেন? তাহা অপেক্ষা জয়ী পক্ষের পাল্লা ভারী করাই শ্রেয়। অনুমান করা যায়, ইহাই নির্বাচন কমিশনকে কংগ্রেস নেতৃত্বের লিখিত চিঠির নিহিত তাগিদ, যে-চিঠিতে প্রাকনির্বাচনী জনমত সমীক্ষা নিষিদ্ধ করার দাবি নথিভুক্ত। অথচ নির্বাচন কমিশন যখন স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া জনমত-সমীক্ষা বন্ধের প্রস্তাব দিয়াছিল, তখন এই কংগ্রেসের নেতৃত্ব ও তাহার পরিচালিত সরকারই তাহা খারিজ করিয়া দেয়। অনিবার্য প্রশ্ন: তবে কি রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন কংগ্রেসের অনুকূল না-হওয়াতেই এ ধরনের সুপারিশ?
কংগ্রেস-চালিত ইউপিএ-২ সরকার অবশ্য কেবল জনমত-সমীক্ষা নয়, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে রাজনীতিকদের মুখোমুখি আলোচনা ও বিতর্কে নামাইয়া দিবারও বিরোধী। সম্প্রতি সরকারের তরফে পরামর্শ দেওয়া হইয়াছে যে, স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতাকে দেশের অন্য কোনও রাজনীতিকের বক্তৃতার সহিত তুলনা করা উচিত নয়। কেন নয়? প্রধানমন্ত্রী কি অন্য রাজনীতিকদের মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন? তাঁহার কি নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে জবাবদিহির দায় নাই? তুলনা, প্রতিতুলনা, আলোচনা, তর্কবিতর্ক, টেলিভিশনের স্টুডিয়োয় অনুষ্ঠিত খোলামেলা প্রশ্নোত্তর-পর্ব পর্দায় ফুটিয়া ওঠা এবং দেশময় সম্প্রচারিত হওয়া কি গণতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক নয়? সরকার তথা শাসক দল কি এগুলি অতঃপর নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহিতেছে? অস্বস্তিকর আলোচনা কিংবা বিতর্কে দলীয় রাজনীতিকদের কোণঠাসা হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করিয়া পছন্দসই চাটুকারবৃত্তিতে আলোচনার জনপরিসর ভরাইয়া দিতে চাহিতেছে? টিভি চ্যানেলের সান্ধ্য অনুষ্ঠানে চলতি রাজনীতির উপর যে জমজমাট সওয়াল-জবাব চলে, তাহা অনেক দর্শককেই আকৃষ্ট করে। জনমতের উপর তাহার প্রভাব আছে, শাসক যাহাকে ভয় পায়। অতএব চাই নিয়ন্ত্রণ?
অনেকেরই প্রসঙ্গত সত্তরের দশকের ‘জরুরি অবস্থা’র কথা মনে পড়িবে। তখন গণমাধ্যম বলিতে কার্যত সংবাদপত্রকেই বুঝাইত। তাহাতে কঠোর সেন্সরশিপ জারি করিয়া ইন্দিরা গাঁধী সে দিন স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেন। বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ হয়। দেশবাসী সেই নিয়ন্ত্রণ সুনজরে দেখেন নাই, প্রথম সুযোগেই ইন্দিরা কংগ্রেসকে ছুড়িয়া ফেলিয়াছিলেন। যাহারা অতীতের ভুল হইতে শিক্ষা গ্রহণ করে না, তাহারা ওই ভুলগুলিরই পুনরাবৃত্তি করিতে নিয়তিবদ্ধ থাকে। সত্য ইহাই যে, জনমত যদি শাসকের বিরুদ্ধে সমাবেশিত হইয়া পড়ে, কোনও নিয়ন্ত্রণই তাহার দিশা পাল্টাইতে পারে না। পরাস্ত শাসককে বরং পরবর্তী জনাদেশের জন্য অপেক্ষা করিতে হয়, নূতন শাসকের ভুল-বিচ্যুতির জন্য অপেক্ষা করিতে হয়। ইউপিএ যদি সে ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তাহার সামনেও ভবিষ্যতে সেই সুযোগ থাকিবে। জনমত-সমীক্ষা নিষিদ্ধ করা কিংবা গণমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ জারি করার অপপ্রয়াস গণতন্ত্রের মূলে অন্তর্ঘাতেরই শামিল হইবে। সমীক্ষা বিজ্ঞানভিত্তিক, না অবৈজ্ঞানিক, তাহা ভুলে-ভরা, না কি অভিসন্ধিমূলক, তাহা যাচাই ও নির্ণয় করার বুদ্ধি একটি প্রাপ্তবয়স্ক গণতন্ত্রের নির্বাচকমণ্ডলীর থাকা উচিত। কোনটি বিষাক্ত আগাছা, আর কোনটি সুগন্ধি পুষ্প, তাহা বিচারের ভারও না-হয় জনসাধারণের উপরেই ছাড়িয়া দেওয়া হউক। |