দু’টি সরকারি আর তিনটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রত্যাখাত হয়ে শনিবার রাত তিনটে নাগাদ দক্ষিণ কলকাতার এক ছোট্ট নার্সিংহোমে জায়গা পেয়েছিলেন অগ্নিদগ্ধ অতসী দাশগুপ্ত। সেখানে আবার পোড়ার চিকিৎসার যথাযথ পরিকাঠামো ছিল না। জ্বালায় ছটফট করতে করতে শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া অতসীদেবী রবিবার সকাল ৭টায় মারা যান। প্রতিবার কালীপুজোর রাতে একাধিক অগ্নিকাণ্ড ও হাসপাতালগুলিতে তার মোকাবিলার যথাযথ পরিকাঠামো না থাকার ফল কী হতে পারে, ই এম বাইপাসের একটি আবাসনের বাসিন্দা অতসীদেবী একা তার প্রমাণ নন। শনিবার রাতে শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে বহু অগ্নিদগ্ধ মানুষকে প্রত্যাখানের অভিযোগ উঠেছে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে আরও এক বার সামনে চলে এসেছে পোড়ার চিকিৎসার মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের অপ্রতুল পরিকাঠামোর বিষয়টি।
সরকারে আসার আট বছর আগে নিজের সাংসদ তহবিলের টাকা থেকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে বার্ন ইউনিট খোলার ব্যবস্থা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতায় আসার পরে নিজে স্বাস্থ্য দফতর হাতে নিয়েও বার্ন ইউনিট বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা একাধিক বার বলেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর দফতরে যে সেই বিষয়টি মেনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এ বারের কালীপুজোয় আবারও তা প্রমাণ হল। মাস কয়েক আগে বিশিষ্ট স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক শোভা ঘোষ আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরে এ ভাবে নানা হাসপাতালে ঘুরে এক ছোট নার্সিংহোমে জায়গা পান। সেখানেই মারা যান। তখন পোড়ার চিকিৎসার পরিকাঠামোর অভাবের বিষয়টি সামনে আসে। তার পরেও পরিস্থিতি এক চুলও বদলায়নি।
বেসরকারি হাসপাতালগুলির সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হসপিটালস অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার সভাপতি রূপালি বসু সমস্যার গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়ে জানিয়েছেন, সংগঠনের পরবর্তী বৈঠকে তাঁরা এ নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন। তিনি বলেন, “প্রতিবার এই সময়ে কত মানুষ হাসপাতালে আসেন সেটা তো আঁচ করে নেওয়াই যায়। সেই অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করে রাখা উচিত। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এই ব্যবস্থাটা থাকা প্রয়োজন। এতে মানুষের হয়রানি অনেকটাই কমবে।”
যদিও বেসরকারি হাসপাতালগুলির কর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন, পুরোদস্তুর বার্ন ইউনিট চালানোর হাজারো ঝক্কি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং পৃথক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স রাখতে হয়। তা ছাড়া পোড়ার ক্ষত সারতে অনেক সময় লাগে। এমনিতেই পোড়ার রোগীকে সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে আলাদা রাখতে হয়। ফলে সেই আলাদা শয্যা মাসের পর মাস আটকে থাকলে সেই শয্যা থেকে হাসপাতালের আয়ের পরিমাণটা কমে। যে হেতু বার্ন ইউনিট রাখা বাধ্যতামূলক নয়, তাই ওই ‘ঝামেলা’-য় জড়াতে চায় না বেশির ভাগ হাসপাতালই।
চিকিৎসকদের মতে, পোড়ার পরে দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। ১৫ শতাংশের বেশি পুড়ে গেলে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। না হলে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় থাকে। অনেকটা জায়গা জুড়ে পোড়ার গভীর ক্ষত হলে এবং ধোঁয়া শ্বাসনালীতে পৌঁছে গেলে কিংবা ওই ব্যক্তির অন্য অসুখ যেমন ডায়াবিটিস থাকলে, দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়া দরকার। না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরে বহু রোগীর ক্ষেত্রে তেমনটাই হচ্ছে।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য অবশ্য কালীপুজোর রাতে রোগী ফেরানোর অভিযোগকে তেমন গুরুত্ব দিতে চাননি। তাঁর কথায়, “এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ দফতরে জমা পড়েনি। পেলে খতিয়ে দেখা হবে।”
এখনও পর্যন্ত এই শহরে পোড়া রোগীদের জন্য বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ১০০টির মতো শয্যা রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যা খুবই অপ্রতুল। যেহেতু পোড়ার রোগীকে মেঝেতে ভর্তি করা যায় না, তাই শয্যা ভর্তি হয়ে গেলে হাসপাতালকে রোগী ফেরাতেই হয়। রাজ্যের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইউনিটটি রয়েছে এসএসকেএমে। সেখানে ৩০টি শয্যা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র অধিকাংশ সময়ে অকেজো। একটি শয্যার সঙ্গে অন্য শয্যার ব্যবধান নামমাত্র। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে আইটিইউ-এ পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে, অথচ ওই বার্ন ইউনিটের আলাদা আইটিইউ নেই। হাসপাতালের জেনারেল আইটিইউ-এ শয্যা খালি পাওয়া যায় না। তখন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু ছাড়া কার্যত অন্য পথ থাকে না।
কেন পোড়ার চিকিৎসার যথাযথ পরিকাঠামো এখনও হল না রাজ্যে? মন্ত্রীর জবাব, “পরিকল্পনা অবশ্যই রয়েছে। একদিনে তো সব কিছু হবে না। ধাপে ধাপে হবে। এম আর বাঙুরে একটি আধুনিক বার্ন ইউনিট খোলা হয়েছে। এসএসকেএম, শম্ভুনাথে তো আগে থেকেই রয়েছে। অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলিতে পৃথক ইউনিট না থাকলেও শয্যার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা পূর্ণাঙ্গ ইউনিট খোলার কথা ভাবছি।” |