২৪ সেপ্টেম্বর রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের সাম্প্রতিক ঘেরাও ইত্যাদি ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ পড়ে মনে হতে পারে, ইদানীং অন্য কয়েকটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ছাত্র বিক্ষোভে নবতম সংযোজন এটি। প্রথমেই বলা ভাল, এটি সম্পূর্ণ আলাদা প্রেক্ষাপটে ও আলাদা কারণে এবং আলাদা দাবিতে ঘটা দীর্ঘকালীন কিছু সমস্যার প্রকাশ। প্রকাশটাও প্রথম নয়। বহু বার, বিভিন্ন ভাবে হয়েছে। সংবাদমাধ্যম ও কর্তৃপক্ষ এতটা গুরুত্ব দেয়নি, এই যা। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালেও মূলত দুটি কারণে বিজ্ঞান কলেজের প্রধান গেট দু’দিনব্যাপী (সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত) অসংগঠিত ভাবে ঘেরাওয়ের ঘটনায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ও তার পর ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসাবে উপাচার্য মহাশয়ের সঙ্গে কিছু দিনের ব্যবধানে ঘটা দুইটি আলোচনাতে সক্রিয় যোগদাতাদের মধ্যে আমিও এক জন। সমস্যাটি স্পষ্ট। চাকরি পাইয়ে দেওয়া নয়, ইন্টারভিউয়ের সুযোগ পাওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা (স্থায়ী ও সংগঠিত ‘প্লেসমেন্ট সেল’) নেই। যেটি যে কোনও টেকনিক্যাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একান্ত জরুরি। উচ্চমানের যাদবপুর-শিবপুর থেকে শুরু করে সদ্য গড়ে ওঠা আমাদের রাজ্যের বেসরকারি টেকনিক্যাল কলেজগুলিতেও যেটি আছে। এমনকী কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা বিভাগের জন্যও আছে। এখানে ‘স্থায়ী’ ও ‘সংগঠিত’, দুটি কথাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর যে কোনও একটির অভাবে সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটাই ব্যাহত হবে।
আমার দেখা (২০০৭-২০১০) বিচ্ছিন্ন অনেকগুলি আন্দোলনের ফলে ২০০৯-এর শেষের দিকে একটি বেসরকারি সদ্য গড়ে ওঠা সংস্থাকে প্লেসমেন্ট সেলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা বসবেন কোথায়, কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে না রাজাবাজার ক্যাম্পাসে, তাঁদের জন্য রুম বরাদ্দ কবে হবে এবং সে রুম কবে কাজের উপযুক্ত হবে, তাঁরা সপ্তাহে ক’দিন আসবেন, কতক্ষণ থাকবেন— এই সব নিয়ে শুধু আলোচনাতেই (পড়ুন বাগ্বিতণ্ডা) কেটে গিয়েছিল কয়েক মাস। |
তার পর কাজ শুরু (খাতায় কলমে) করার কিছু দিন পরেও কোনও হেলদোল না-দেখে আমরা কয়েক জন ছাত্রছাত্রী কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে অভিযোগ জানাতে গিয়ে খুবই সমস্যায় পড়েছিলাম। ওখানে সবাই এতটাই ব্যস্ত যে, এই তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়ই ছিল না কারও কাছে। শেষে দায়িত্বে থাকা এক জন অধ্যাপক এসে ছাত্র সংসদের রুমে বসে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। জানতে পারি, প্লেসমেন্ট সেলের জন্য কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে একটি রুম বরাদ্দ হয়েছে, কিন্তু কাজের উপযুক্ত হতে কিছু দিন (পড়ুন কয়েক মাস) সময় লাগবে, তাই প্লেসমেন্ট সেলের প্রতিনিধিরা আপাতত রাজাবাজার ক্যাম্পাসেই আসবেন। ওঁদের এক প্রতিনিধির ফোন নম্বর দিয়ে বলা হয়, যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব আমাদের। বহু বার যোগাযোগ করার পরে কিছুটা বাধ্য হয়েই ওই সংস্থাটির এক প্রতিনিধি রাজাবাজার ক্যাম্পাসে কয়েক বার এসেছিলেন সিনিয়রদের তথ্যাবলি সংগ্রহ করতে। অনেক চেষ্টা করেও রুমের বন্দোবস্ত করতে না-পেরে, মনে আছে, ওই প্রতিনিধিকে নিয়ে আমরা তিন তলায় আমাদের ক্লাসরুমে গিয়ে বসেছিলাম। সিনিয়রদের তথ্য সংগ্রহ করা ছিল খুবই কঠিন কাজ। কোনও সেন্ট্রাল ডেটা বেস ছিল না। আমাদের বিভাগেও ছিল না। (অন্য বিভাগের কথা জানি না)। অধ্যাপকদের কাছেও পাইনি। একটু বেশি বার জিজ্ঞাসা করাতে ওঁরা বলেছিলেন, ও সব ওঁদের কাজ নয়। কয়েক জন বলেছিলেন, ‘নিজেরাই তো করতে পার, ই-মেল, অর্কুট এ সব ঘেঁটে দেখো (তখন ফেসবুক এত পরিচিত হয়নি)। রিইউনিয়নে প্রকাশিত পুস্তিকায় পিছনের পাতায় কিছু ঠিকানা, ফোন নম্বর থাকলেও সেগুলি আপডেটেড ছিল না। এরই মাঝে আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল। কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সের কিছু ছাত্রকে পরীক্ষায় বসতে দেয়নি, পাঠক্রমটি তিন বছরের বি টেক হওয়ার জন্য (যদিও এটি এ আই সি টি-র অনুমোদন করা পাঠক্রম)।
মূলত এই দুটি কারণে কিছু বিচ্ছিন্ন আন্দোলন শুরু হয়, যা শেষ পর্যন্ত উল্লিখিত গেট ঘেরাওয়ের (২০১০ সালের শুরুর দিকে) রূপ নিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায়। প্রথম দিন কেউ পাত্তা না-দিলেও দ্বিতীয় দিনে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম আসে। অল্পবিস্তর খবর হয়। উপাচার্য মহাশয় আলোচনায় ডাকেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় স্থায়ী ও উপযুক্ত পরিকাঠামো-সহ প্লেসমেন্ট সেল তৈরি হবে। দুর্ভাগ্যবশত, কাজের কাজ হয়নি। আসলে কর্তৃপক্ষের কঠোর অবস্থান, পুলিশ, উচ্চতর হস্তক্ষেপ বা ঘেরাও কোনওটাই নয়, দরকার মানসিকতার কয়েকটি পরিবর্তন। একটি স্থায়ী ও সংগঠিত প্লেসমেন্ট সেল। একটি কাজকর্মের উপযোগী ঘর (অবশ্যই রাজাবাজার ক্যাম্পাসের মধ্যেই) তিন জন স্থায়ী দক্ষ কর্মী, যাঁদের একজন প্লেসমেন্ট অফিসার, অন্য দু’জন সহকারী অফিসার। সব বিভাগের অন্তত একজন করে ছাত্র ও অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক ও প্লেসমেন্ট সেল-এর তিন জনকে নিয়ে গঠিত একটি কমিটি। যেটি প্লেসমেন্ট সেল-এর কাজ দেখাশোনা ও সহায়তা করবে। প্রথম কাজ সিনিয়রদের ও সংস্থায় ডেটা বেস তৈরি যা প্রাথমিক ভাবে বিভাগের অধ্যাপকদের থেকে নিতে হবে। দ্বিতীয় কাজ সরাসরি বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে অন্য কিছু কলেজের সঙ্গে একত্রে উপযুক্ত সংস্থাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা। তৃতীয় কাজ ছাত্রদের ব্যবহারিক মান উন্নয়নের (মূলত পার্সোনালিটি ডেভেলপমেন্ট, স্পোকেন ইংলিশ ইত্যাদি) জন্য বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। এক মাস, দু’মাস নয়, নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক ভাবে করতে হবে এই কাজগুলি।
দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এ ভাবে চললে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কলেজটি চাকরি পাওয়ার তালিকায় সেরা একটিতে পরিণত হবে। কারণ, ওখানে যারা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় তারা বি এসসি (অনার্স)-এ সবচেয়ে উপরের দিকে থাকা ছাত্র। এবং ভারতে, এমনকী গোটা বিশ্বে কেমিস্ট্রি পড়া কেমিক্যাল বা পলিমার ইঞ্জিনিয়ার বা ফিজিক্স পড়া ইলেকট্রিকাল বা ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার প্রায় নেই বললেই চলে। চাকরি বা গবেষণার ক্ষেত্রে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলন বা ঘেরাও কোনও সমাধান দেবে না, কিন্তু সব কিছু দেখেশুনে চুপচাপ মেনে নেওয়াটাও তো কোনও সমাধান দেয়নি এত দিন। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই পাঠ্যক্রমের যোগ্য মর্যাদা ও বিকাশলাভের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা তৈরি করতে চাইলে নিশ্চয়ই তা সম্ভব। |