পরশুরাম লিখিয়াছিলেন, শরতের গোড়ায় বাজারে পটল চড়িতেছে, আলু নামিতেছে। পঞ্জিকার পাতায় শরৎ বিদায় লইয়াছে, কিন্তু বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে কেহ নামিবার নাম করে না। আলু চড়িতেছে, পেঁয়াজ, বেগুনও। মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠিতেছে। এই বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধি যে বাজারের নিয়ম মানিয়া হইতেছে না, তেমন সন্দেহ করিবার কারণ বিলক্ষণ আছে। হিমঘরে আলুর অভাব নাই, নূতন আলু উঠিবারও সময় হইয়াছে। অনুমান করা চলে, জোগান-শৃঙ্খলের কোনও একটি বা একাধিক বিন্দুতে কেহ অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জনের খেলা খেলিতেছে। এই অবস্থায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যদি এই অস্বাভাবিকতা দূর করিবার চেষ্টা করেন, তাহাতে নীতিগত আপত্তি থাকিবার কথা নহে। প্রশ্ন তাঁহার পন্থা লইয়া। মুখ্যমন্ত্রী জানাইলেন, এই রাজ্য হইতে আপাতত ভিন্ রাজ্যে সবজি পাঠানো চলিবে না। অনুমান করা চলে, তিনি ভারত এবং সেই ভারতের বাজারের অখণ্ডতায় বিশ্বাস হারান নাই। সেই অখণ্ড বাজারের একটি রাজ্য হইতে অন্য রাজ্যে পণ্য না পাঠাইবার সিদ্ধান্তটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর নীতির ধোপে টিকিবে না। কিন্তু, নীতির প্রশ্নটি যদি আপাতত মুলতবিও রাখা হয়, তবু তাঁহার এই সিদ্ধান্তটি বাজারকে অকুশলী করিবে। বাজারের একটি সমস্যা সমাধান করিতে গিয়া বৃহত্তর সমস্যা ডাকিয়া আনা কাজের কথা নহে। মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তটি অবশ্যই সাময়িক, কিন্তু কয়েক দিনের জন্যেও এমন সিদ্ধান্ত করা চলে কি না, মুখ্যমন্ত্রীকে ভাবিয়া দেখিতে হইবে।
মুখ্যমন্ত্রী আলুর দাম বাঁধিয়া দিয়াছেন। সেই দামের অধিক মূল্যে আলু বিক্রয় করায় কতিপয় ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। কেহ আইন ভাঙিলে তাহাকে গ্রেফতার করাই বিধেয়। কিন্তু তাহার পূর্বে দুইটি প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব প্রয়োজন। প্রথমত, যে কারণে এই ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা হইল, তাহা সত্যই আইন মানিয়া হইয়াছে কি? অধুনা পশ্চিমবঙ্গে এই প্রশ্নটিকে অবান্তর বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ার অবকাশ নাই। তবু আশা করা চলে, প্রশাসন যাহা করিয়াছে, আইন মানিয়াই করিয়াছে— নিছক মুখ্যমন্ত্রীর মন বুঝিয়া নহে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি বৃহত্তর— যদি এমন আইন থাকেও, তাহা যথেষ্ট বিবেচনা না করিয়া প্রয়োগ করা নৈতিক ভাবে সমর্থনযোগ্য কি? আইনি এবং নৈতিক আচরণ যে এক কথা না-ও হইতে পারে, তাহার বহু উদাহরণ সাম্প্রতিক ভারতেই রহিয়াছে। যথা, শিল্পপতি কুমারমঙ্গলম বিড়লার ক্ষেত্রে সি বি আই যাহা করিয়াছে, তাহা ‘বেআইনি’ না হইতে পারে, কিন্তু কাজটি নৈতিক হয় নাই। এই প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীকে আরও একটি কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাউক। বাজার স্তব্ধ হইয়া গেলে তো তাঁহার চলিবে না। এই গ্রেফতারির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীরা ধর্মঘটের হুমকি দিয়াছেন। তাহা ঠিক হউক বা ভুল, বাজারের পক্ষে ক্ষতিকারক। এই ক্ষতি যদি সরকারের অনৈতিক আচরণের ফলে হয়, তাহা আরও শোচনীয়।
এক্ষণে দুইটি আশঙ্কা প্রকট হইতেছে। প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা এবং পুলিশের গ্রেফতারির ঘটনা দুইটি যে ব্যবধানে ঘটিল, তাহাতে সংশয় জাগে, পুলিশের সিদ্ধান্তটি তাৎক্ষণিক, ফলে অবিবেচনাপ্রসূত। বাজার যদি প্রশাসনের বিবেচনায় আস্থা হারায়, তবে তাহা অকুশলী এবং ফাটকাপ্রবণ হইয়া উঠিতে বাধ্য। তাহা মুখ্যমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের বিপ্রতীপ হইবে। দ্বিতীয়ত, বামপন্থার ভূত মুখ্যমন্ত্রীকে ছাড়ে নাই। বামপন্থীরা বাজারে বিশ্বাস করিতেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের দাবিটি তাঁহারা আজও ছাড়েন নাই। সাধ্যে কুলাইলে তাঁহারা বাজারের চিহ্ন পর্যন্ত রাখিতেন না। বামপন্থী পূর্বসূরিদের প্রতি যাবতীয় বিদ্বেষসমেত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— অন্য নানা বিষয়ের মতোই এই বিষয়েও— তাঁহাদেরই পথে হাঁটিতেছেন কি না, ভাবিয়া দেখিতে পারেন। |