বহু বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েও সৌরজগৎ বা তার বাইরের বিশাল ব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবীর মতো আর একটা গ্রহ খুঁজে পাননি বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর যে বৈশিষ্ট্য তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে, তা হল প্রাণ। কিন্তু এই প্রাণ তৈরি হল কোথা থেকে? কী ভাবে? কোথায়? এই প্রশ্ন বছরের পর বছর তাড়া করে বেড়িয়েছে বিজ্ঞানীদের। তৈরি হয়েছে নানা তত্ত্ব। এ বার সেই তালিকায় যুক্ত হল এক বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম। নাম শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শঙ্করবাবু পেশায় জীবাশ্মবিদ। পৃথিবী থেকে ডাইনোসর লুপ্ত হয়ে গেল কী করে, তা নিয়ে তাঁর গবেষণা দেশবিদেশে সাড়া জাগিয়েছে। এ বার তাঁর দাবি, পৃথিবীতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার রহস্য উদ্ধার করতে পেরেছেন তিনি। বা আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে প্রাণ তৈরির আঁতুড়ঘরকে খুঁজে বার করেছেন তিনি।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে অনেক দিন আগেই জানিয়েছিলেন, প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে প্রাণ এসেছিল পৃথিবীতে। তবে সমুদ্র না মিষ্টি জলের পুকুর, কোথায় তার আবির্ভাব, তা নিয়ে রয়েই গিয়েছে মতভেদ। শঙ্করবাবু বললেন, “প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবী সৃষ্টি হয়, তখন আবহাওয়া ছিল ভয়ঙ্কর। প্রাণ সৃষ্টির কোনও পরিবেশই ছিল না। থেকে থেকে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বিষাক্ত গ্যাসে ভরে ছিল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। তার উপর মাঝেমধ্যেই পৃথিবীতে খসে পড়ত উল্কার টুকরো। পৃথিবীর বুকে দিনরাত বৃষ্টির মতো আছড়ে পড়ত ধূমকেতু।” তবে তাঁর মতে, এই মহাজাগতিক বস্তুই শেষে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল পৃথিবীর জন্য। শঙ্করবাবু টেক্সাস থেকে ফোনে জানালেন, এই ধূমকেতু আর উল্কার টুকরো পৃথিবীর বুকে বিশাল বড় বড় গর্ত তৈরি করেছিল। তাঁর দাবি, এই মহাজাগতিক বস্তুই তাদের গায়ে জড়িয়ে বরফ এনেছিল পৃথিবীতে আর সেই জলেই মিশে ছিল প্রাণ তৈরির প্রাথমিক উপাদান। সেই মহাজাগতিক জল একে একে ভরিয়ে দেয় সব ক’টা গর্ত। তৈরি হয় সমুদ্র। কিন্তু আগ্নেয়গিরি ঠান্ডা হল না। সমুদ্রের তলাতেই তারা লাভা উদ্গিরণ করতে লাগল। যার নাম দেওয়া হয় ‘হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট’। |
শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। ২০১০-এ সেরা বাঙালির মঞ্চে। —ফাইল চিত্র। |
শঙ্করবাবু জানালেন, পৃথিবী সৃষ্টির পরে প্রথম ৫০-৬০ কোটি বছর এই অবস্থা চলল। এর পর আজ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে শুরু হল প্রাণ তৈরির প্রক্রিয়া। তিনি জানালেন, মূলত চারটে ধাপে পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে প্রাণ। প্রথম ধাপে উল্কা আর ধূমকেতু সঙ্গে করে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিল প্রাণ সৃজণের প্রাথমিক উপাদান আর জল। যাকে বলে ‘কসমিক স্টেজ’। এর পর এল ‘জিওলজিক্যাল স্টেজ’। যেখানে সমুদ্রের গভীরে গাঢ় অন্ধকারে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একটু একটু করে উল্কা আর ধূমকেতুর নিয়ে আসা উপাদানগুলো জুড়ে তৈরি হয় জটিল যৌগ। শঙ্করবাবুর কথায় এটা অনেকটা বিভিন্ন সব্জি আর মশলা নিয়ে রান্না করার মতো ঘটনা। আর এ ক্ষেত্রে আগুনের কাজ করেছিল হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের উষ্ণতা। ৩০০-৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। তার পরের স্টেজের নাম ‘কেমিক্যাল স্টেজ’। সেখানে যৌগগুলো নিজেদের মতো সাজিয়েগুছিয়ে তৈরি হল আরও জটিল যৌগ। তৈরি হল আরএনএ, প্রোটিন। আর সেই প্রোটিন আর আরএনএ থেকে আরও জটিল বিক্রিয়ায় এল ডিএনএ। তৈরি হল কোষ। পৃথিবীর প্রথম প্রাণ। স্টেজের নাম ‘বায়োলজিক্যাল স্টেজ’।
বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা প্রাণের উৎস খোঁজার উদ্দেশ্যে বহু বছর ধরেই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর জন্য তাঁরা গ্রিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি অঞ্চলে পাওয়া জীবাশ্ম আর পাথরের সাহায্য নিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে শঙ্করবাবু জানালেন, ওই অঞ্চলেই এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সব থেকে পুরনো জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে। মিলেছে এমন কিছু পাথর, যা এসেছে পৃথিবীর বাইরে থেকে। সম্ভবত কোনও উল্কা বা ধূমকেতুর টুকরো।
শঙ্করবাবুর কথায়, “এত দিন কী ভাবে প্রাণ তৈরি হয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কোথায় তৈরি হয়েছে তা ঠিক জানা ছিল না।” আর এটাতেই জোর দিয়েছেন তিনি। ওই জীবাশ্মবিদ বলছেন, “সমুদ্রের গভীরে তৈরি হওয়া ওই গর্তগুলো অনেকটা রান্নার কড়াইয়ের কাজ করে। কোনও ডাইনোসর খুঁজে পাওয়ার থেকেও এটা অনেক বড় ব্যাপার। এটা অনেকটা বিজ্ঞানের হোলি গ্রেল খুঁজে পাওয়ার মতো।” ডেনভারে জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকার বার্ষিক সভায় শঙ্করবাবু তাঁর এই তত্ত্ব পেশ করেছেন। সমাদৃতও হয়েছেন।
কিন্তু যে-ধূমকেতু আর উল্কা পৃথিবীতে প্রাণ নিয়ে এল, সেই-সৃষ্টিকর্তা মাঝেমধ্যে সংহারকও হয়ে ওঠে। এমনই কোনও মহাজাগতিক পাথরের ধাক্কাতেই হয়তো পৃথিবী থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে ডাইনোসর। ২০১০ সালে এই তত্ত্বের জন্য এবিপি আনন্দের ‘সেরা বাঙালি’ আর ‘সেরার সেরা’ পুরস্কার পান শঙ্করবাবু। নিজের এই তত্ত্বের প্রমাণ জোগাড় করতে তিনি এখন খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন মুম্বইয়ের উপকূলে। |