একাত্তরে পরাজয় নিশ্চিত জেনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা নেয় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী জামাতে ইসলামির নেতৃত্ব। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা শুরু হয় স্বাধীনতার পক্ষে থাকা বিশিষ্ট অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চিকিৎসককে। ৪২ বছর পরে সেই মামলায় দুই জামাত নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিল যুদ্ধাপরাধ আদালত। আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুইনুদ্দিন নামে জামাতের এই দুই নেতা পাক বাহিনীর সহযোগী আল বদর-এর পাণ্ডা ছিলেন। আশরাফুজ্জামান পাকিস্তান হয়ে আমেরিকায় ও মুইনুদ্দিন ব্রিটেনে পালিয়ে গিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই আজ রায় ঘোষণা করেন বিচারকরা। |
|
|
মুইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান
|
|
একাত্তরে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি থেকে পাকিস্তান বুঝে যায়, পরাজয় নিশ্চিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি মানা ছাড়া গতি নেই। এই পরিস্থিতিতে সহযোগী রাজাকার, আল বদর ও আল শামস সংগঠনের নেতাদের নিয়ে স্বাধীনতাকামী বিশিষ্ট বাঙালিদের খুূন করার একটি সবিস্তার পরিকল্পনা করে পাক বাহিনী। আশরাফুজ্জামানের বাড়ি থেকে পাওয়া একটি ডায়েরিতে বিভিন্ন বৈঠক ও আলোচনা সভার বিবরণী থেকে এই চক্রান্তের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের একটি উদ্দেশ্য যদি বাঙালিকে নাগরিক নেতৃত্বহীন করে তোলা হয়, দ্বিতীয়টি অবশ্যই গায়ের জ্বালা মেটানো। ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয় ১৮ জন বিশিষ্ট বাঙালিকে। এর মধ্যে ৯ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ৬ জন সাংবাদিক ও ৩ জন চিকিৎসক। এদের অনেকেরই দেহ মেলেনি।
আশরাফুজ্জামান ও মুইনুদ্দিন, একাত্তরে দু’জনেই জামাতে ইসলামির ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। পাক বাহিনীর সহযোগী আল বদর-এর নেতৃত্বেও তাদের নিয়োগ করে জামাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার কারণে তাঁরা অধ্যাপকদের চিনতেন। আবার দু’জনেই কয়েকটি সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করার কারণে কোন কোন সম্পাদক বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে, সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। এঁরাই ‘হিটলিস্ট’ তৈরি করতেন ও তার পরে পাক সেনাদের সঙ্গে নিয়ে তালিকায় থাকা বিশিষ্ট জনের বাড়িতে হানা দিতেন।
তাঁদের দুই ছাত্রই ঘাতকদের সঙ্গে নিয়ে হাসিমুখে বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে দেখে বিস্মিত হতেন ঢাকার অধ্যাপকরা। তার পরে ছাত্রদের হুকুম তামিল করে পাক বাহিনীর অস্থায়ী ছাউনিতে যেতে হত তাঁদের। সেখান থেকে কেউই আর ফেরেননি। পাঁচ-ছ’দিন পরে কারও কারও দেহ পাওয়া গিয়েছিল রায়ের মাঠের ভাগাড়ে। মৃতদেহের আঘাতের চিহ্নেই স্পষ্ট, প্রচণ্ড নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের। নিহতদের মধ্যে ছিলেন শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদক ও বিশিষ্ট লেখিকা সেলিনা পারভিন, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব মুনীর চৌধুরী, সম্পাদক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারও।
দেশের স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বিশিষ্ট জনেদের এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৫-এ তিনি সপরিবার খুন হয়ে যাওয়ার পরে তা পদে পদে বাধা পায়। আগের বিএনপি-জামাতের আমলেও দোষীদের আড়াল করতে মামলাটি দুর্বল করে দেওয়া হয়। আশরাফুজ্জামান ও মুইনুদ্দিন যথাক্রমে আমেরিকা ও ব্রিটেনের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই থেকে যান। অপরাধের ৪২ বছর পরে তাঁদের ফাঁসির আদেশ দিল যুদ্ধাপরাধ আদালত। এই রায়ের পরে তাঁদের দেশে ফেরানোর চেষ্টা করা হবে। |