দেহের রক্ত জল করে রোজগার করেন ওঁরা। আর সেই রোজগারের টাকাই চলে যায় সুদখোরদের কবলে। সুদের হার সময়-সময় কাবুলিওয়ালাদেরও লজ্জা দেবে। কিন্তু বিকল্প কোনও পথ না থাকায় ‘চটাওয়ালা’দের হাতেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন শেওড়াফুলি গড়বাগানের যৌনপল্লির মেয়েরা। এই চক্রব্যুহ থেকে এ বার তাঁদের বের করে আনতে উদ্যোগী হল বৈদ্যবাটি-শেওড়াফুলি সমবায় ব্যাঙ্ক।
বহু যুগ ধরে শেওড়াফুলির এই পল্লিতে যৌনব্যবসা চলে। বর্তমানে এখানকার কম-বেশি ৬৫টি বাড়িতে এই ব্যবসা চলে। পেশার সঙ্গে জড়িত নানা বয়সের তিনশোরও বেশি মহিলা। বাড়িওয়ালাদের একাংশের হিসেব অনুযায়ী, একটি মেয়ে পেশা শুরুর পরে ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ব্যাঙ্কে ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা জমিয়ে ফেলতে পারতেন। কিন্তু পারেন কই! চটজলদি টাকার প্রয়োজনে তাঁরা দৈনন্দিন সুদে টাকা ধার নেন এলাকার কিছু সুদখোরের কাছে। স্থানীয় পরিভাষায় এর নাম ‘চটা সুদ’। চড়া সুদ শোধ হতেই চায় না।
স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রতি একশো টাকায় দৈনিক ২ থেকে শুরু করে ১০ টাকা বা তারও বেশি সুদের হার। তাতেই রাজী হয়ে যান তরুণী। ধরা যাক কেউ ১০ হাজার টাকা ঋণ নিলেন। প্রতি ১০০ টাকায় দৈনিক ৫ টাকা হারে তাঁর সুদ গিয়ে দাঁড়ায় দৈনিক ৫০০ টাকা। যে কোনও পরিস্থিতিতে ওই টাকা শোধ করতে বাধ্য হন তাঁরা। দু’-তিন দিন বাকি পড়লেই কপালে জোটে গালিগালাজ। ব্যবসা করা দায় হয়ে পড়ে। অনেকে এই জাল কেটে বেরোতে পারেন না। আগের ঋণ শুধতে নতুন কোনও চটাওয়ালার দ্বারস্থ হন তাঁরা। আর বয়স হলে কেউ ঝি-গিরি, কেউ বা ভিক্ষে করে পেট চালান। এমন উদাহরণ ভুরি-ভুরি। চটাওয়ালারাই এখানে এক ধরণের ‘ব্যাঙ্কিং সিস্টেম’। |
তাদের হাত দিয়ে কত টাকা যে লেনদেন হয়, তার কোনও হিসেব নেই। সংশ্লিষ্ট সব মহলের বক্তব্য, মেয়েদের যে ‘বাবু’ থাকেন, তাঁর খাই মেটাতেই আরও গাড্ডায় পড়েন তাঁরা। অনেক ক্ষেত্রেই বাবুর চাহিদা মেটাতে ধার করতে হয় চটাওয়ালার কাছে।
তবে, সবাই অবশ্য সমান নন। কেউ যৌনপেশার রোজগারে কয়েক লক্ষ টাকার বাড়ি বানিয়েছেন। কেউ মেয়েকে ভর্তি করিয়েছেন বোর্ডিংয়ে। কেউ আবার নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠান। কিন্তু অধিকাংশেরই সঙ্গী হয় দুর্দশা। কেউ হয়তো নিজের গ্রামে আত্মীয়দের টাকা পাঠান নিয়মিত। কেউ জমি কেনেন। কিন্তু গ্রামে যে হেতু প্রবেশ নিষেধ, তাই জমি কিনতে হয় কোনও আত্মীয়ের নামে। যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’র এক কর্তা বলছিলেন, “এক যৌনকর্মী নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। বছর ত্রিশের মহিলার এখন দুই সন্তান। সম্প্রতি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কাজ করতে পারছেন না। চিকিৎসা আর পেট চালানোর জন্য পরিবারের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরিবার তাকে সটান না বলে দিয়েছে।”
এই অবস্থায় যৌনকর্মীদের টাকা সুরক্ষিত রাখতে উদ্যোগী হয়েছে বৈদ্যবাটি-শেওড়াফুলি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক। যৌনকর্মীদের ‘জিরো ব্যালেন্স’ অ্যাকাউন্ট খুলতে শুরু করেছে তারা। সম্প্রতি ওই পল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে স্থানীয় সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ওই সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমিতাভ মজুমদারের কাছে ওই অ্যাকাউন্ট খোলার আবেদন জানান। এর পরেই ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ রীতিমতো শিবির খুলে অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করেন। অমিতাভবাবু জানান, ইতিমধ্যেই ৪০ জনের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। আরও হবে। অমিতাভবাবু বলেন, “ওঁরা যদি স্বনির্ভর হতে চান, তা হলে ব্যাঙ্ক পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। চটাওয়ালা এবং চিটফান্ডের হাত থেকেও ওঁরা বাঁচবেন।” শুধু চটাওয়ালাই নয়, ভুইফোঁড় অর্থলগ্লি সংস্থায় জমিয়েও কয়েক লক্ষ টাকা খুইয়েছেন এইমেয়েরা। এই অবস্থা থেকে এই পল্লিকে বের করে আনতে চাইছে সমবায়। ওই ব্যাঙ্ক সূত্রে জানানো হয়েছে, স্থানীয় কাউন্সিলর রোজগারের শংসাপত্র দিলেই অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি অবশ্য গত কয়েক বছর ধরেই এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৫ সালে ‘ঊষা মালটিপারপাস সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি সমবায় তৈরি করে তারা। প্রথমে হাতে গোনা ১৩ জন যৌনকর্মীকে নিয়ে সমবায়টি চালু হয় কলকাতায়। ২০০৬ সালে হাওড়া, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং দুই ২৪ পরগনায় চালু হয়। শেষে ২০০৯ সালে রাজ্যের প্রতিটি যৌনপল্লিতে প্রবেশ করে এই সমবায়। সমবায়ের ম্যানেজার শান্তনু চট্টোপাধ্যায় জানান, বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা কুড়ি হাজার ছুইছুই। বার্ষিক লেনদেন ১৭ কোটি টাকারও বেশি। গত বছর হাজার পাঁচেক মহিলাকে ঋণ দেওয়া হয়। ঋণের পরিমান ৫ কোটি টাকা। মূলত বাড়ি তৈরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুরনো ঋণ শোধের জন্য ঊষা থেকে ঋণ নেন যৌনকর্মীরা। চলতি অর্থবর্ষে দেয় ঋণের পরিমান ৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দুর্বার সূত্রের খবর, কিছু দিনের মধ্যেই দিনহাটা, বসিরহাট, ডোমজুড়ে শাখা খোলা হবে। শেওড়াফুলি অথবা টিটাগড়ের মধ্যে কোনও একটি জায়গায় শাখা খোলা হবে। শেওড়াফুলিতে জনা ষাটেক মহিলা ঊষার সদস্য। সমবায় ব্যাঙ্কের একাংশের বক্তব্য, ঊষায় ঋণ দেওয়ার অঙ্ক খুব বেশি নয়। সেই কারণেই সব ক্ষেত্রে মেয়েদের চাহিদা মেটে না। ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে এই সমস্যা থাকবে না। ঊষার কর্তারা সে কথা মানেননি।
ঊষার এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য শঙ্করী দাস বলেন, “যৌনকর্মীদের জীবনে চটাওয়ালারা অভিশাপ। আমি ঊষায় একাধিক প্রকল্পে টাকা জমাই। আমার কোনও সমস্যা নেই।” পূজা দাসের কথায়, “সাত বছর হল এখানে আছি। অনেক মেয়েকেই চটাওয়ালাদের থেকে ঋণ নিয়ে সমস্যায় পড়তে দেখেছি। তাড়াতাড়ি মেয়েরা এটা বুঝতে পারলেই মঙ্গল।” শেওড়াফুলি দুর্বারের প্রোগ্রাম ম্যানেজার বিশ্বজিৎ মোদকও সায় দেন সেই কথায়।
মর্যাদা এবংর সমানাধিকারের জন্য যৌনপল্লির মেয়েদের লড়াইয়ে তাদের পাশে সমবায় কিংবা ব্যাঙ্ক দাঁড়ায় কি না, সেটাই এখন দেখার। |