আলোচনা, বৈঠক, কথাবার্তা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা তালিবানি সন্ত্রাসকে এ পথেই নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছিল পাকিস্তান সরকার। কিন্তু শুক্রবার, সিআইএ-র ড্রোন হানায় তালিবান নেতা হাকিমুল্লা মেহসুদের মৃত্যুতে সে প্রক্রিয়া অনেকটাই বাধা পেল বলে আশঙ্কা পাক রাজনীতিকদের। শনিবার প্রাক্তন নেতার অন্ত্যেষ্টিতে পাক তালিবান জানিয়েছে, ‘শান্তিকামী’ পাক সরকারের মদতেই ঘটেছে হামলা। তাদের হুমকি, “আমরা আমাদের শত্রুদের হাড়ে হাড়ে চিনি।”
আর সে শত্রুদের জবাব দিতে তারা যে জোরদার প্রস্তুতি শুরু করেছে, সেটাও পরিষ্কার। হাকিমুল্লার মৃত্যুর এক দিন পরে অর্থাৎ শনিবারই নতুন নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে তেহরিক ই তালিবান পাকিস্তানের কাউন্সিল বা ‘শুরা’। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছিল, এর পর থেকে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেবে খান সৈয়দ মেহসুদ ওরফে ‘সজনা’। করাচির এক নৌসেনা ঘাঁটিতে হামলার ছক কষা, ২০১২ সালে বান্নুর এক জেল থেকে ৪০০ কয়েদিকে ছাড়িয়ে নেওয়ার মতো নানা কাণ্ডের ‘মাথা’ ছিল সজনা। কিন্তু পরে জানানো হয়, কয়েক জন কম্যাণ্ডার সজনাকে প্রধান হিসেবে মানতে নারাজ। আপাতত তাই শেহরিয়ার মেহসুদকে তদারকি প্রধান করা হয়েছে। তালিবান সূত্রে খবর, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন নেতার নির্বাচন শেষ করে ফেলবে তারা। এ হেন অবস্থায়ও তালিবানি কম্যান্ডারের হুঙ্কার, “আমাদের প্রতিশোধ আগের সমস্ত কিছু ছাপিয়ে যাবে।”
গত কাল উত্তর ওয়াজিরিস্তানের রাজধানী মিরানশাহ থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে ডাণ্ডে ডারপাখেলে চলে ড্রোন হামলা। নিহত হয় হাকিমুল্লা মেহসুদ ও আরও পাঁচ জন। আর তাতেই নতুন করে ক্ষুব্ধ তালিবান। |
যার জেরে ফের পাক মাটিতে রক্তপাতের আশঙ্কা। গত কাল থেকেই তা ভাবাচ্ছে প্রশাসনকে। দেশময় শুধু আমেরিকা-বিরোধী প্রতিক্রিয়া। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী চৌধুরি নিসার আলি খান সরাসরি বলেছেন, “শান্তি প্রক্তিয়া ভেস্তে দিতে আমেরিকা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হাকিমুল্লা মেহসুদের উপর ড্রোন হানা চালিয়েছে।” এর পর আমেরিকার সঙ্গে সমস্ত সমঝোতা নিয়ে নতুন করে ভাববে পাকিস্তান, জানান নিসার। মেহসুদের মৃত্যুর কথা না তুলেও পাক বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, এই হামলা পাক সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। তেহরিক ই ইনসাফ দলের প্রধান ইমরান খানের দাবি, এ ভাবে সরকারতালিবান শান্তি প্রক্রিয়ায় জল ঢেলে দিল আমেরিকা। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সরকারের মতামতে সিলমোহর দিচ্ছেন না পাক গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের ব্যাখ্যা দু’টি। প্রথমত, হাকিমুল্লা মেহসুদের মতো এক নির্বিকার হত্যাকারীর এমন পরিণতিই হওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, এতে কিছুটা হলেও উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সাংগঠনিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে তালিবান। ফলে এখনই বড়সড় হামলার আশঙ্কা কম। তবে এর পরও যদি বড় মাপের হামলা চালায় পাক তালিবান, সে ক্ষেত্রে বুঝতে হবে, ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর শিকড় বেশ শক্তপোক্ত। সে আশঙ্কা থেকেই পাকিস্তানের বড় শহরগুলিতে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে প্রশাসন। ইসলামাবাদ এবং পেশওয়ার এই দু’টি শহরেই বিপদের আশঙ্কা সব চেয়ে বেশি। পুলিশকর্মী, নিরাপত্তারক্ষীদের ভিড়ে ছয়লাপ শহরগুলি। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনগুলিতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি, নিরাপত্তা।
কিন্তু এত তৎপরতা, উত্তেজনা, উদ্বেগ এড়ানোর জন্যই পাকিস্তানে ড্রোন হানা বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছিল সরকার। সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরেও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ড্রোন হানা বন্ধের আর্জি জানিয়েছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। ২০১৪-র মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে আমেরিকা। ফলে আফগানিস্তান এবং লাগোয়া পাক মাটিতে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে তালিবানি সন্ত্রাস, সে আশঙ্কা থেকেই জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি-আলোচনার পথে এগোচ্ছিল পাক সরকার।
কিন্তু গত কালের ড্রোন হামলা বদলে দিল ছবিটা। আমেরিকা হাকিমুল্লা মেহসুদের মাথার দাম ঘোষণা করেছিল ৫০ লক্ষ ডলার। তার মৃত্যুর পর পাক সরকারতালিবান সম্পর্কে ফের উত্তেজনার অশনি সঙ্কেত। এর মূল্য ঠিক কতটা, কী ভাবেই বা চোকাতে হবে, তা জানাবে ভবিষ্যৎই। |