আয়লার ঘা, ধুঁকছে সুন্দরবনের পরের প্রজন্মও
রাজিনা খাতুন। বয়স দু’বছর। ঠিকানা রামচন্দ্রপুর। থানা পাথরপ্রতিমা। দক্ষিণ ২৪ পরগনা।
রাজিনা ভাল ভাবে হাঁটতে পারে না, খেতে পর্যন্ত পারে না। হাড় জিরজিরে শিশুটিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যেতেও ভয় পান তার বাবা-মা। যদি ওই যাতায়াতের ধকল তার রুগ্ণ শরীর সইতে না পারে!
মন্দিরবাজারের কাশীপুর গ্রামের চার বছরের অজয় মণ্ডলের জন্মাবধি শ্বাসকষ্ট। মাসভর পেট খারাপ। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারে না। সম্প্রতি তার দেহে পাওয়া গিয়েছে কলেরার রোটা ভাইরাস।
গোপালনগর গ্রামের সুদাম বারুইয়ের বয়সও বছর চারেক। বুকের সব ক’টা হাড় গোনা যায়। ফুসফুসে সংক্রমণ। একটানা পাঁচ মিনিট নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও নেই তার।
এরা সকলেই সুন্দরবনের আয়লা-উত্তর পর্বের প্রজন্ম। চার বছর আগের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আয়লা ওই প্রজন্মের শিশু এবং তাদের মায়েদের উপরে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা খতিয়ে দেখতে সমীক্ষা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেজ (নাইসেড)। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সেই সমীক্ষার রিপোর্ট। আর সেই রিপোর্টেই সুন্দরবনের আগামী দিনের নাগরিকদের শারীরিক অবস্থার এই হাড় জিরজিরে ছবিটা ফুটে উঠেছে।
রাজিনা, অজয়, সুদামদের শরীর-স্বাস্থ্যের এই হাল কেন? সুন্দরবনে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা জানাচ্ছেন, আয়লার ঝড়ের তিন দিন পরে বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল সুদামের। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ভিজে বিছানাতেই বড় হয়েছে সে। রাজিনা পেটে থাকার সময়ে মা সামশুনা বিবি দু’বেলা পেট ভরে খেতে পাননি। আয়লার ঝড়ে সামশুনাদের চালাঘর উড়ে গিয়েছিল। ভেসে যায় সামান্য সঞ্চয়টুকুও। শরীরে বাসা বেঁধেছিল রোগ। সে সবের সুরাহা হওয়ার আগেই সন্তান আসে তাঁর গর্ভে। আয়লার ক্ষতির সমস্ত চিহ্ন নিজের শরীরে নিয়েই বড় হয়েছে সেই সন্তান রাজিনা। ফের ঝড় শুধু অজয়দের ছোট্ট বাড়িটাই নষ্ট করেনি, নষ্ট করে দিয়েছিল তার বাবার এক চিলতে চাষের জমিটাও। আজও চাষ হয় না সে জমিতে। অজয়ের বাবা অক্ষয় মন্ডল মুম্বইয়ে এক রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে।
আয়লা বিধ্বস্ত সুন্দরবনের মহিলা ও শিশুদের কী অবস্থা দেখেছেন নাইসেডের সমীক্ষকেরা? রিপোর্ট বলছে, চার বছর পরেও আয়লার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি সুন্দরবন। জমি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই জমিতে ফসল ফলে না। রুজির তাগিদে পুরুষেরা ঘর ছেড়ে ভিন রাজ্যে চলে গিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে মহিলাদের গর্ভধারণের সংখ্যা। মেয়েদের শরীরে রক্তাল্পতা বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে। বিধ্বংসী ওই ঝড়ের পরে জন্মানো শিশুদের একটা বড় অংশই ভয়াবহ অপুষ্টির শিকার। তাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা ধরনের সংক্রমণ। বেশির ভাগ সময়ে তারা জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভোগে। রিপোর্টে স্পষ্ট যে ওই ঝড়ে তছনছ হওয়া জীবন এখনও গুছিয়ে উঠতে পারেননি সুন্দরবনের মানুষ।
শুধু এই প্রজন্মই নয়, পরবর্তী প্রজন্মও যে আয়লার প্রভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে, তার প্রমাণ রাজিনা, অজয়-রা। নাইসেড-এর গবেষক সমীরণ পাণ্ডা বলেন, “৬০ শতাংশ মহিলার রক্তাল্পতা পেয়েছি আমরা। ২৫ শতাংশ শিশু অতি তীব্র অপুষ্টির (সিভিয়র অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন) শিকার। এদের ১৫ শতাংশেরই ঘন ঘন জ্বর, ডায়েরিয়া আর শ্বাসকষ্ট হয়।”
পাথরপ্রতিমা ব্লকের দুর্বাচটি, রামগঙ্গা, গোপালনগর, দক্ষিণ রায়পুর এবং শ্রীনারায়ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় সমীক্ষা চালিয়ে নাইসেডের গবেষকরা দেখেছেন, ঝড়ে ঘর তো উড়েইছে, যাঁদের শৌচাগার ছিল, তা-ও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে খোলা জায়গায় মলত্যাগের অভ্যাস ওই সব এলাকায় প্রায় সর্বজনীন চেহারা নিয়েছে। শিশুরা খালি পায়ে হাঁটে। মাটি থেকে কৃমি শিশুদের পায়ের চামড়া ভেদ করে খাদ্যনালীতে বাসা বাঁধছে। শিশুদের মল পরীক্ষা করে কলেরার ভাইরাসেরও সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণুও মিলেছে।
সুন্দরবনের উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা সমাজকর্মী তুষার কাঞ্জিলাল জানান, আয়লার পরে বহু লোক বাইরে চলে গিয়েছেন। কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাইয়ের বস্তিতে থাকেন ওঁরা। ছ’মাসে এক বার বাড়ি আসেন। ন্যূনতম রক্তপরীক্ষাও হয় না তাঁদের। বহু ক্ষেত্রে তাঁদের এইচআইভি সংক্রমণের ভয় থেকে যায়। তাঁর কথায়, “সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চার দিকে গাছ পচে রয়েছে, মাছ পচে রয়েছে, পানযোগ্য জল নেই। স্বাস্থ্য পরিষেবাও তলানিতে। পরিস্থিতি এমনই যে, বহু ক্ষেত্রে প্রসবের আগে বা পরে প্রসূতিরদের চেকআপটুকুও হয় না। রোগ নিয়েই বেড়ে উঠছে শিশুরা। কোনও প্রোটিন পড়ে না তাদের শরীরে। এ ভাবে তারা কত দিন লড়াই করবে কে জানে!”
সুন্দরবনের মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের হাল হকিকত নিয়ে কাজ করছে যে সব সংগঠন তারাও জানিয়েছে, গত চার বছরে পরিস্থিতির অবনতির হার উদ্বেগজনক। এমন একটি সংগঠনের পূর্বাঞ্চলের অ্যাসোসিয়েট জেনারেল ম্যানেজার সত্যগোপাল দে বলেন, “সরকারি নীতির মধ্যে অপুষ্টি দূর করার পদক্ষেপগুলি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তাই জেলা ও রাজ্য স্তরে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই আমরা কাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছি।” সুন্দরবন উন্নয়নে যুক্ত অন্য একটি সংস্থার সভাপতি গোপাল প্রামাণিক বলেন, “অপুষ্টির শিকার শিশুদের চিহ্নিত করাটা খুব জরুরি। আমরা অঙ্গনওয়াড়ি, আশা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য প্রকল্পের কর্মীদের সাহায্য নিয়ে এই কাজ চালাচ্ছি।”
পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক তা মানছেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “সুন্দরবনের উন্নয়ন নিয়ে ধাপে ধাপে কাজ হচ্ছে। আয়লায় ক্ষতিটা মারাত্মক তা জানি। বেসরকারি সংগঠনগুলির সঙ্গে মিলেই কাজ চালাচ্ছি। তবে ক্ষতির পরিমাণ এতটাই বিপুল, যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগবে।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.