|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
লেখকের কণ্ঠস্বর বেশি শোনা যায় |
অভিজিৎ গুপ্ত |
দ্য লোল্যান্ড: আ নভেল, ঝুম্পা লাহিড়ি। র্যান্ডম হাউস ইন্ডিয়া, ৩৪০.০০ |
ইতালীয় লেখক জর্জিও বাসানির যে দু’টি পঙক্তিকে (‘...let me return to my home town entombed/ in grass as in a warm and high sea’) অবলম্বন করে ঝুম্পা লাহিড়ির দ্য লোল্যান্ড উপন্যাসের সূচনা, তা মনে করায় উনিশ শতকের এক লেখকের অসম্পূর্ণ শেষ উপন্যাসের নান্দীমুখ:
‘And here afar,
Intent on my own race and place, I wrote’।
প্রশান্ত মহাসাগরের সামোয়া দ্বীপে বসে উত্তুরে হাওয়া-তাড়িত এডিনবরার যে স্মৃতি-প্রতিসৃত কল্পচ্ছবি দেখেছিলেন রবার্ট লুইস স্টিভেনসন, তা আজ অভিবাসী বা diaspora সাহিত্যের নিয়ত-অনুশীলিত এক প্রকরণ, এমনকী বহুল ব্যবহারে কথঞ্চিত জীর্ণ। এই আশঙ্কা নিয়ে দ্য লোল্যান্ড পড়তে শুরু করেছিলাম, আরও শঙ্কা ছিল কাহিনি নিয়েও— সত্তর দশক ও নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিত কী ভাবে উদ্ধার করবেন পরবর্তী ও প্রবাসী প্রজন্মের ঝুম্পা। এ বিষয় নিয়ে বাংলা সাহিত্যের যে প্রাচুর্য ও বৈচিত্র, তার প্রভাবকেই বা কী ভাবে গ্রহণ বা বর্জন করবেন লেখক?
যেহেতু এর মধ্যে উপন্যাসটি অনেকেই পড়েছেন, তাই কাহিনির সামান্য আভাস দেওয়া গেল: সুভাষ ও উদয়ন মিত্র দুই ভাই, জ্যেষ্ঠ সুভাষ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণ করে উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিন মুলুকে স্থিত, ছোট উদয়ন প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যা পড়তে পড়তে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। সহপাঠিনী গৌরীকে বিবাহ করে উদয়ন, সে খবর আমেরিকায় বসে ভাইয়ের চিঠিতে জানতে পারে সুভাষ, আরও জানে যে, এই বিবাহে সম্মতি ছিল না তাদের বাবা-মায়ের। গৌরীর গর্ভে সন্তান আসে, কিন্তু সে সন্তানের জন্মের আগেই পুলিশের হাতে খুন হয় উদয়ন। এ খবর পেয়ে যখন কলকাতায় ফেলে সুভাষ, টালিগঞ্জের বাড়িতে গৌরীর একাকিত্ব ও অবহেলা তাকে ব্যথিত করে, কোনও এক অব্যক্ত দায়িত্ববোধ বা উদয়নের শূন্যস্থান পূরণের তাগিদে গৌরীকে বিবাহ করে আমেরিকায় নিয়ে আসে সে। আর গৌরী? ‘She had married Subhas as a means of staying connected with Udayan. But even as she was going through with it she knew that it was useless, just as it was useless to save a single earring when the other half of the pair of was lost.’ অনতিকাল পরেই বেলা নামের কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় গৌরী, কিন্তু মাতৃত্ব থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। রোড আইল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে দর্শন পড়তে শুরু করে সে। ক্রমশ গবেষণার আকর্ষণ তার সত্তাকে সম্পূর্ণ ভাবে অধিকার করে। পরিবার ও অতীত থেকে নিজেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন দিয়ে এক অন্যতর জীবন ও সম্ভাবনা উন্মোচিত করে গৌরী। অন্য দিকে সুভাষের জীবন ছুঁয়ে থাকে এক দিকে টালিগঞ্জের বাড়ি, অন্য দিকে বেলা ও তার ব্যতিক্রমী মাতৃত্ব। এই তিন প্রজন্মের টানাপড়েনের মাঝখানে, নিউ ইংল্যান্ডের অপূর্ব নিসর্গের আশ্রয়ে, স্থিতির সন্ধান করে সুভাষ।
দ্য লোল্যান্ড উপন্যাস দু’টি ভূগোলকে অবলম্বন করে নির্মিত, কিন্তু দুই নির্মিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। সত্তরের কলকাতা নিউজরিল বা খবরের কাগজের আবছা ছবির মতো প্রতিভাত— সেখানে চরিত্রদের মনোজগৎ তীক্ষ্ণ আখরে বিবৃত কিন্তু তাদের পরিপার্শ্ব নিতান্তই ধূসর ও বৈশিষ্ট্যবর্জিত। শুধু জেগে থাকে টালিগঞ্জের দেশপ্রাণ শাসমল রোডে মিত্র পরিবারের বাড়ির কাছে দু’টি পাশাপাশি পুকুর। বর্ষাকালে প্রায়ই জল উঠে দু’টি পুকুরের জল এক করে দিত, তার পিছনের জলাভূমিতে সারা বছর ধরে জমত জল ও কচুরিপানা। এই জলাভূমি বা লোল্যান্ড এই কাহিনির প্রস্থানভূমি, এখানেই সংঘটিত হয় উদয়ন মিত্রের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড এবং এই উপচে পড়া পুকুরের জলের মতোই স্মৃতি ও ইতিহাস দুই ভাইয়ের জীবন ঢেকে দেয়। এই উপন্যাসের দ্বিতীয় ভূগোলের সন্ধানে ঝুম্পা ফিরে গেছেন তাঁর শৈশবের রোড আইল্যান্ড রাজ্যে, যা আমেরিকার পূর্ব উপকূল ও অতলান্তিক মহাসাগরের সংযোগস্থলে এক টুকরো ভূখণ্ড। রোড আইল্যান্ডের তটরেখা টালিগঞ্জ থেকে বহু সহস্র যোজন দূরে, তবু দুইয়ের মধ্যে যোগাযোগ খুঁজে পায় সুভাষ: ‘Both places were close to sea level, with estuaries where fresh and salt water combined. As Tollygunge, in a previous era, had been flooded by the sea, all of Rhode Island, he learned, had once been covered with sheets of ice. The advance and retreat of glaciers...had created marshes and the bay, dunes and moraines. They had shaped the current shore.’ উপন্যাসের মধ্যভাগ ও উপান্তে আমেরিকার এই অঞ্চলের প্রতি লেখকের অবধান মনে করায় ‘নিউ ইংল্যান্ড’ সাহিত্য-ধারার কথা, উনিশ শতকে ন্যাথানিয়েল হথর্ন ও হার্মান মেলভিল থেকে শুরু করে বিশ শতকে এলিজাবেথ বিশপ, জন চিভার প্রমুখের লেখায় যার এক স্বতন্ত্র পরিচয় নির্মিত হয়েছে। ঝুম্পার এই উপন্যাসটিও প্রধানত সেই গোত্রের বলে মনে হয়েছে।
রচনাশৈলী ও চরিত্রচিত্রণে ঝুম্পার দক্ষতার পরিচয় আমরা আগেই পেয়েছি। কিন্তু ছোটগল্পে যে সীমিত পরিসরের মধ্যে একটি চরিত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, উপন্যাসের সে বাধ্যবাধকতা নেই। এর সুবিধে-অসুবিধে দুটোই। উনিশ-শতকীয় ধাঁচে omniscient narrator হতে গিয়ে চরিত্রদের সম্পর্কে বড় বেশি বলে ফেলা যায়, তাদের মনোজগতের অতি-গভীরে প্রবেশ করতে গিয়ে representation বা উপস্থাপনার রীতিনীতি লঙ্ঘিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। দ্য লোল্যান্ড পড়তে গিয়ে কখনও কখনও মনে হয়েছে টালিগঞ্জ থেকে রোড আইল্যান্ড নির্বিশেষে সকলের স্বর যেন একই গ্রামে বাঁধা, চরিত্রদের নিজস্ব স্বর ছাপিয়ে বড় বেশি শোনা গেছে লেখকের কণ্ঠস্বর। ঝুম্পার লেখার প্রসাদগুণ অনবদ্য, তাই পড়তে গিয়ে হয়ত পাঠক অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না, কিন্তু চরিত্রদের প্রতি অতিরিক্ত অভিভাবকত্ব এই উপন্যাসের প্রধান দুর্বলতা।
তা সত্ত্বেও ঝুম্পার এই উপন্যাস সাম্প্রতিক অভিবাসী সাহিত্যধারায় একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। লেখকের জবানিতে, প্রায় এক দশক ধরে এই উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তিনি নিজেকে পরিচিত করেছেন। বিষয়ের প্রতি এই দায়বদ্ধতা ও ধৈর্যশীলতার ছাপ উপন্যাসটির স্থাপত্যে সুস্পষ্ট। নকশাল আমলের ইতিহাস অনেকাংশেই এক স্মৃতিনির্ভর প্রকল্প, এবং তার মালিকানা ও অধিকার-অনধিকার চর্চার চাপান-উতোর এখনও বিদ্যমান। এই ইতিহাসের স্মৃতিনির্ভরতা ও অনিশ্চয়তাকে ব্যবহার করে লেখক যে কাহিনি নির্মাণ করেছেন, তাতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাজনীতির ত্রিভুজের মধ্যে নিপুণ ভাবে ধরা পড়েছে আধুনিক বাঙালি জীবনের এক বেদনাময় জবানবন্দি। শুধুমাত্র ইতিহাস-বিলাস এই উপন্যাসের প্রতিপাদ্য নয়, ইতিহাস থেকে উত্তরণের সম্ভাবনাও এই উপন্যাসে উপ্ত। |
|
|
|
|
|