সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী শক্তিকে একজোট করতে লোকসভা ভোটের আগে কোমর বেঁধেছে বামেরা। এক মঞ্চে আনা হচ্ছে নানা আঞ্চলিক দলকে। কিন্তু তৃণমূল কেন নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে অবস্থান পরিষ্কার করছে না, সেই প্রশ্ন তুলে এ বার রাজ্যের শাসক দলকে বিঁধতে শুরু করল সিপিএম। সংখ্যালঘু-প্রধান দেগঙ্গায় এসে শুক্রবার কৌশলে তৃণমূল-বিজেপি আঁতাঁতের অভিযোগই
তুলে দিয়ে গেলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
দু’মাস ধরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা জুড়ে সিপিএমের যে ৪০টি জনসভা করার কর্মসূচি, দেগঙ্গায় এ দিন বুদ্ধবাবুকে দিয়েই তার সূচনা হয়েছে। যেখানে সিপিএমের এই পলিটব্যুরো সদস্য সরাসরিই বলেছেন, “তৃণমূল-বিজেপি গোপন আঁতাঁত হয়েছে! সতর্ক থাকুন!” ভবিষ্যতে সুযোগ পেলেই ঘাসফুল আর পদ্মফুল মিলে যাবে বলেও কটাক্ষ করেছেন বুদ্ধবাবু। তাঁর আহ্বান, “এ রাজ্যের মাটি তৃণমূলকে তুলে দিয়ে রাজ্যকে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে ছেড়ে দেবেন না। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলে বড় সর্বনাশ!” বুদ্ধবাবুর আগে বক্তৃতা করতে উঠে সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেবও প্রশ্ন তুলেছেন, “দেশের অধিকাংশ দল যখন মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চাইছে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরা তখন চুপ করে আছেন কেন?” |
বস্তুত, মোদী সম্পর্কে তৃণমূলের অবস্থানই যে এখন তাঁদের প্রচারের হাতিয়ার, তা এ দিন কলকাতায় এসে স্পষ্ট করে দিয়েছেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরিও। অ-কংগ্রেস, অ-বিজেপি দল হওয়া সত্ত্বেও তৃণমূল কেন দিল্লিতে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সম্মেলনে ডাক পাননি? ইয়েচুরি বলেছেন, “যারা ওখানে এসেছিল, তারা সকলেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরব। কিন্তু তৃণমূল এই ব্যাপার অবস্থান স্পষ্ট করেনি। তাই তাদের ডাকার প্রশ্ন ওঠে না।” তার আগে বেহালায় একটি পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পরে তথাকথিত তৃতীয় ফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ইয়েচুরি ক্রিকেটীয় ভাষায় মন্তব্য করেছেন, “কোনও প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় ফ্রন্ট নেই। ক্রিকেটে ‘দুসরা’ কাকে বলে জানেন তো! এটা সেই বল, যা ব্যাটসম্যান খেলতে পারেন না। আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান। আমরা সেই রকম দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ‘দুসরা’ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরাতে চাইছি!”
মোদী বা বিজেপি নিয়ে তাদের কী বক্তব্য, সরাসরি সেই প্রশ্নে না-গিয়ে তৃণমূল অবশ্য পাল্টা আক্রমণ করেছে সিপিএমকেই। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, “বুদ্ধবাবুর কথা এখন কেউ শোনে না! বিশ্বাসও করে না! বাংলাকে তিনি যে দুর্দশার মধ্যে ফেলে গিয়েছেন, তার জন্য এ রাজ্যের মানুষ তাঁর কাছে কৈফিয়ৎ চাইছে!” বুদ্ধবাবুকে নিশানা করে তাঁর আরও মন্তব্য, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় যে উন্নয়নযজ্ঞ শুরু করেছেন, তাতে রাজ্যবাসী তাঁর উপরেই আস্থা রাখছেন। সে কারণেই বুদ্ধবাবু চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন! তার জন্যই পদ্ম আর ঘাসফুলকে তিনি এক করে ফেলেছেন!”
দেঙ্গার ফুটবল মাঠে বুদ্ধবাবুর সভায় এ দিন ভিড় হয়েছিল ভালই।
যা দেখে দৃশ্যতই তৃপ্ত মনে হয়েছে বাম নেতৃত্বকে। পঞ্চায়েত ভোটে ভরাডুবির মধ্যেও এই এলাকার ফলাফল শক্তি জুগিয়েছিল সিপিএমকে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ ধরে রাখতে না-পারলেও দেগঙ্গায় জেলা পরিষদের তিনটি আসনেই জয়ী হয়েছে তারা। এই ব্লকে ১৩টি পঞ্চায়েতের ৮টিতে একক ভাবে ক্ষমতায় এসেছে বামেরা।
সংখ্যালঘু এলাকায় সভামঞ্চ থেকে তৃণমূল সরকারের সংখ্যালঘু-নীতিরও নিন্দা করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ইমাম-ভাতার প্রসঙ্গ টেনে তাঁর মন্তব্য, “তা হলে তো পুরোহিতদেরও টাকা দিতে হয়! মিথ্যা কথা বলে এক জনকে ভাতা দিতে গিয়ে ফাঁপরে পড়েছে! ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের এ ভাবে অপমান করতে গেলেন কেন?” মুখ্যমন্ত্রীর নাম না-করেও প্রাক্তনের কটাক্ষ, “মুসলিমদের জন্য ঘোমটা পরে মুখে দরদ দেখাচ্ছেন! অথচ কাজের কাজ কিছুই করছেন না!”
শাসক দলের কাজকর্মের তীব্র সমালোচনা করে তিনি এ-ও বলেছেন, “এ এক অদ্ভুত সরকার চলছে! মন্ত্রীরা কেবল পুজো আর জলসা করে বেড়াচ্ছেন! ক্লাবগুলোকে টাকা দেওয়া হচ্ছে মারামারি আর গুণ্ডামি করার জন্য। লক্ষ লক্ষ টাকা পুজোর জন্য খরচ করছে!” সাম্প্রতিক কালের নারী নিগ্রহের লাগাতার ঘটনার সূত্র ধরে পুলিশের সমালোচনাও শোনা গিয়েছে প্রাক্তন পুলিশমন্ত্রীর মুখে। বলেছেন, “এখন দাদাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে পুলিশ! তাই কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবককেও ভয় পাচ্ছে তারা!” সভার শুরুর দিকে গৌতমবাবুর পাশের চেয়ারেই এ দিন দেখা গিয়েছিল শাসনের সিপিএম নেতা মজিদ আলি ওরফে মজিদ মাস্টারকে। বুদ্ধবাবুর বক্তৃতা শুরুর আগে অবশ্য মজিদ মঞ্চ থেকে নেমে যান। মজিদের জোনাল কমিটি ভেঙে মুখ বদলানোর প্রক্রিয়ায় গৌতমবাবুদের সিদ্ধান্তে নেপথ্যে মদত ছিল বুদ্ধবাবুরই। |