শ্রীলঙ্কায় চলতি মাসে অনুষ্ঠেয় কমনওয়েল্থ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের যোগদানের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারতের তামিল রাজনীতিকরা যে আপত্তি ও প্রতিবাদ জানাইতেছিলেন, তাহার ওজন ও ধার অনেকটাই হ্রাস পাইয়া গিয়াছে। শ্রীলঙ্কার তামিলপ্রধান উত্তর প্রদেশের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী বিঘ্নেশ্বরণ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে জাফনা সফরের আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন। আড়াই দশক ব্যাপী গৃহযুদ্ধে তামিল গেরিলা ও শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর তরফে এই জাফনার দখলই ছিল লড়াইয়ের নির্ণায়ক পর্ব। কিন্তু তাহার পর পক প্রণালী দিয়া অনেক জল বহিয়াছে। উত্তর ও পূর্ব শ্রীলঙ্কার তামিল জনপদগুলিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়া যে তামিল জনপ্রতিনিধিরা প্রাদেশিক স্তরে ক্ষমতাসীন, তাঁহারা ইলম অর্থাৎ স্বতন্ত্র তামিল রাষ্ট্রের পক্ষপাতী নন, শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক অখণ্ডতা শিরোধার্য করিয়াই তামিল স্বশাসন অর্জনে প্রয়াসী। তাঁহারাই মনমোহন সিংহকে জাফনা সফরে আমন্ত্রণ জানানোয় ভারতীয় তামিল রাজনীতিকদের পালের হাওয়া পড়িয়া গিয়াছে।
হাওয়ার তেজ বাড়িয়াছে ভারতে লোকসভা নির্বাচন আসন্ন হওয়ায়। ডিএমকে ও এডিএমকে, উভয়েই দ্বীপভূমির তামিলদের স্বার্থরক্ষার প্রতিযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীর উপর এই মর্মে চাপ সৃষ্টি করে যে, শ্রীলঙ্কার তামিলদের রক্তে রঞ্জিত-হস্ত প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষের আতিথ্য গ্রহণ করা অনুচিত হইবে। তামিলনাড়ু বিধানসভায় এই মর্মে সর্বদলীয় প্রস্তাবও গৃহীত হইয়াছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁহার বিদেশ দফতরও সম্ভবত কিছুটা দ্বিধার মধ্যে পড়িয়া গিয়া থাকিবেন। নির্বাচন বলিয়া কথা। কিন্তু শ্রীলঙ্কার তামিলরাই যখন মনমোহনকে আমন্ত্রণ জানান, তখন ভারতীয় তামিল রাজনীতিকদের দেউলিয়াপনা প্রকট হইয়া পড়ে। আসলে এই রাজনীতিকরা এখনও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা, সেখানকার তামিলদের বাধ্যবাধকতা এবং প্রতিবেশীর সহিত ভারত সরকারের সম্পর্কের জটিলতা উপলব্ধি করিতে পারেন না বা চাহেন না। শ্রীলঙ্কার তামিলরা নিশ্চয়ই সে দেশে জাতিগত বৈষম্য ও বঞ্চনার পাশাপাশি দমনপীড়নেরও শিকার। কিন্তু তৎসত্ত্বেও অধিকাংশ তামিল যে এলটিটিই-র স্বৈরাচারের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়া জনপ্রতিনিধিদের শাসনকে শ্রেয় ভাবিতেছেন, ইহার তাৎপর্য ভারতের তামিল রাজনীতিকদের অনুধাবন করা দরকার।
কলম্বোর সহিত সুসম্পর্ক দিল্লির পক্ষে মূল্যবান। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের সহিত ভারতের মিত্রতা সুলভ নহে। নেপাল চিনের কোলে ঢলিয়া পড়িতেছে, ভুটানেও তাহার প্রাথমিক সংকেত। মলদ্বীপ অবধি ভারতকে চোখ রাঙাইতেছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মৈত্রী চাহিলেও তাহার প্রাপ্য জলের ভাগ ও ছিটমহলের জমি না দেওয়ায় ভারতের উপর অপ্রসন্ন। পাকিস্তান, পাকিস্তানই। শ্রীলঙ্কা এখনও নয়াদিল্লির সহিত নিবিড় সখ্য চায়। তাহার পিছনে অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির সক্রিয় তাগিদ অবশ্যই আছে। কিন্তু একই সঙ্গে চিনের সহিত সুসম্পর্কের ক্ষেত্র প্রসারিত করার বিকল্পও কলম্বোর সামনে খোলা। জয়ললিতা কিংবা করুণানিধির এ সব লইয়া ভাবনা নাই, তাঁহারা নিজ-নিজ নির্বাচনী গণভিত্তি অটুট রাখিতেই উদ্গ্রীব। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে প্রাদেশিক রাজনীতিকদের সংকীর্ণ খেলায় জড়াইলে চলিবে না, তাঁহাকে কলম্বোর বিমান ধরিতে হইবে। |