ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত গণতন্ত্রের মূল কাঠামোটি অক্ষুণ্ণ রাখিতে সুপ্রিম কোর্ট যে ভূমিকা পালন করিয়াছে, তাহার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বস্তুত, সংবিধান অনুসারে গণতন্ত্রের তিনটি বিভাগ আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ এবং বিচারবিভাগ কোন পরিসরে কাজ করিবে, সুপ্রিম কোর্টই অতীতে একাধিক মামলার রায় ঘোষণা করিবার সময় সেই ব্যাখ্যা করিয়াছে। অতএব, সুপ্রিম কোর্ট তাহার সংবিধান-স্বীকৃত এক্তিয়ারের কথা বিস্মৃত হইয়াছে, এমন কথা ভাবিবার নিশ্চয়ই কোনও কারণ নাই। কোর্টের এই ঐতিহাসিক ভূমিকাটি স্মরণে রাখিয়া একটি সশ্রদ্ধ এবং সবিনয় প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন বিচারপতি কে এস পানিকর রাধাকৃষ্ণণ এবং বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষের বেঞ্চ সিভিল সার্ভিস বোর্ড গঠনের যে নির্দেশ দিল, সেই নির্দেশ কি বিচারবিভাগের অধিকারের সীমাবহির্ভূত নহে? আমলাতন্ত্রের উপর যে অযৌক্তিক, অনৈতিক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা তাঁহারা উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা অনস্বীকার্য। তাঁহারা আমলাদের বদলির যে বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলিয়াছেন, তাহাও যে বর্তমান ব্যবস্থার তুলনায় উন্নততর হইবে, তাহাও সংশয়াতীত। কিন্তু, যথার্থ গন্তব্যে পৌঁছাইতে পারাই যথেষ্ট নহে, পথটিও সমান জরুরি। আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক পুতুলনাচ হইতে মুক্ত করা অতি জরুরি, কিন্তু সেই কাজটি সুপ্রিম কোর্টের নহে। বিচারবিভাগের এই অতিসক্রিয়তা আপাতদৃষ্টিতে গণতন্ত্রের পক্ষে মঙ্গলদায়ক বলিয়া ভ্রম হইলেও প্রকৃতার্থে ক্ষতিকর নয় কি? তাহা কি গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলির ভিত দুর্বল করিয়া দিবে না?
কেহ বলিতে পারেন, সুপ্রিম কোর্ট স্বপ্রবৃত্ত হইয়া এই নির্দেশ দেয় নাই। ইহা একটি জনস্বার্থ মামলার ফল। এবং, আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক দখলদারি হইতে রক্ষা করিতে যে সাধারণ মানুষ যে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া ভিন্ন কোনও পথ দেখিতে পান না, তাহা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অনাস্থা প্রস্তাব। রাজনীতিকরা নিজগুণে যে অতলে নামিয়াছেন, তাহাতে এই অনাস্থা প্রশ্নাতীত। সুপ্রিম কোর্ট এই সর্বজনীন বিপন্নতা বিষয়ে সহানুভূতিশীলও হইতে পারে। কিন্তু, এই জাতীয় জনস্বার্থ মামলা গ্রহণ করা কি আদালতের পক্ষে বিধেয়? বিচারবিভাগের কাজ আইনানুগ পথে মামলার ফয়সলা করা, সংবিধানের ব্যাখ্যা দেওয়া। দেশের শাসনযন্ত্র যথাযথ কাজ করিতেছে কি না, তাহা দেখা শাসনবিভাগের দায়িত্ব। সেই কাজে শাসনবিভাগ বহু ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হইতেছে। কিন্তু, সেই ব্যর্থতা হইতে দেশকে উদ্ধার করিবার কাজটি, তাহা যতই মহৎ হউক, আইনবিভাগের এক্তিয়ারভুক্ত নহে। জনমানসে সুপ্রিম কোর্ট এখন অভূতপূর্ব সম্মানের অধিকারী। সেই কারণেই নিজের সীমা বিস্মৃত না হওয়া আরও জরুরি।
আর একটি প্রশ্ন উঠিবে। শাসনবিভাগ যদি এই ভাবেই ব্যর্থ হইতে থাকে, এবং আইনবিভাগ যদি হস্তক্ষেপ না করে, তবে সাধারণ মানুষ দাঁড়াইবেন কোথায়? প্রশ্নকর্তারা ভুলিয়া যান, নাই নাই করিয়াও ভারতে গণতন্ত্র এখনও বেশ শক্তিশালী। নির্বাচনের সময় তো বটেই, অন্য সময়েও রাজনীতিকরা আর সাধারণ মানুষকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করিতে পারেন না। তাহার একটি বড় প্রমাণ এই বৎসরের গোড়ায় মিলিয়াছিল। ধর্ষণের শাস্তি সংক্রান্ত নূতন আইন প্রণয়ন করিতে মাত্র দুই মাস সময় লাগিয়াছিল। তাহার একমাত্র কারণ, নাগরিক সমাজের চাপ রাজনীতিকরা ঠেকাইতে পারেন নাই। এই চাপই মানুষের শক্তি। শাসনবিভাগ যদি তাহার কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হয়, মানুষ যদি সেই ব্যর্থতায় যথেষ্ট পরিমাণে বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হন, তবে চাপ তৈরি হইবে। তাহাই গণতন্ত্রের শক্তি। শুধু রাজপথ দখল করিয়া আন্দোলন নহে, সাধারণ মানুষের চাপ আইনসভায়, গণতন্ত্রের যথার্থ পরিসরে, স্থান পায়। তাহাই গণতন্ত্রের পথ। বিচারবিভাগ শাসনবিভাগের কাজ করিয়া দিবে, তাহা কাম্য নহে। |