|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
সাধনার সুর-তত্ত্বে বাউল ও সহজিয়ার সাধকরা |
সম্প্রতি গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় অনুষ্ঠিত কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তের প্রদর্শনী দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘অবতলের রূপাবলী’। এক জন নবীন, উদীয়মান শিল্পীর আঁকা ছবি। আর সেই ছবির প্রেরণায় এক জন প্রবীন লেখক, গবেষক ও কবির লেখা কবিতা। এই দুইয়ের যুগলবন্দি প্রদর্শনী। শিল্পীর নাম কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত। চিত্রকলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই শিল্পী হিসেবে ইতিমধ্যেই নিজস্ব পরিসর তৈরি করেছেন। কবিতা লিখেছেন যিনি তিনি স্বনামধন্য। তিনি সুধীর চক্রবর্তী। প্রথম জীবনে লিখতেন কবিতা। তার পর নিমগ্ন হয়েছেন সঙ্গীত ও লৌকিক জীবনের নানা দিক নিয়ে অনুপুঙ্খ গবেষণায়। তাঁদের এই যুগলবন্দি প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায়। কৃষ্ণজিৎ এঁকেছেন বাউল ও সহজিয়া সাধকদের ছবি। সেই ছবির প্রেরণায় সুধীর লিখেছেন কবিতা। কবিতার ভিতর দিয়ে উন্মীলিত করেছেন সহজিয়া সাধনার নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সুর ও তত্ত্ব।
কিন্তু কেবল দুইয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি এই প্রকল্প। আরও এক জন শিল্পী ও এক জন কবি অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এই প্রকল্পে। এই প্রদর্শনীরই স্মারক হিসেবে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ‘ধ্রুবপদ’ প্রকাশনী থেকে। বইটির নাম ‘অবতলের রূপাবলী অবতলের পদাবলী’। এখানে কৃষ্ণজিতের ছবি ও সুধীর চক্রবর্তীর কবিতা তো রয়েছেই পাশাপাশি। এ ছাড়াও আছে সেই কবিতার ইংরেজি রূপান্তর। অনুবাদ করেছেন তরুণকান্তি সেন। এই তিন জনের কাজের পাশাপাশি উপস্থাপনার ভিতর অনুপ্রবেশ করেছেন চতুর্থ শিল্পী: স্বনামখ্যাত সুব্রত চৌধুরী। অনবদ্য রেখায় তিনি এঁকেছেন বাউলের জীবন ও নানা আলেখ্য।
প্রদর্শনীতে প্রবেশের আগে বুঝে নেওয়া যেতে পারে, কাকে বলে ‘অবতল’। ভূমিকাস্বরূপ লেখায় সেটা সুন্দর বুঝিয়েছেন সুধীর চক্রবর্তী। লিখেছেন: ‘আমাদের সাজানো গোছানো পরিপাটি জীবনযাপনের নাগরিক প্রচ্ছদের সমান্তরালে বয়ে চলেছে প্রধানত গ্রামীণ পরিসরে রহস্যময় অবতলের সাবলীল বিন্যাসের আরেক রকম বাঁচা। তাঁরা অভাবী কিন্তু আমুদে, বাইরের চাকচিক্যের বদলে নিজস্ব অঙ্গবস্ত্রে বর্ণময়, গানে গানে গাঁথা তাঁদের পর্যটন, ঠাঁইনাড়া পরিযায়ী তাঁদের স্বভাব।’ এই যে দীর্ঘ প্রবাহিত লৌকিক পরম্পরার সাধক ও শিল্পী এই প্রান্তিক মানুষ তাঁদের জীবন ও সাধনাকে ছবিতে সামগ্রিক ভাবে ধরা খুব কঠিন। ছবি তো একটি মুহূর্তকে, একটি ভঙ্গিকে মাত্র রূপবদ্ধ করতে পারে। |
|
শিল্পী: কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত। |
অবশ্য সেই এককের দৃশ্যরূপায়ণের মধ্যে উদ্ভাসিত হয় যে ‘রূপ’, তা আমাদের কল্পনায় বিচিত্র ও বিপুল ঢেউ তোলে। তা থেকে আমরা নিজেদের মতো করে সত্যের একটি রূপরেখা তৈরি করে নিতে পারি। কবিতা রূপরেখার সেই বিস্তারেরই দৃষ্টান্ত। ছবি সব সময়ই প্রতীক-নিভর্র্র। কবিতা অনেক বেশি প্রতীকী। সময়ের প্রবহমানতা থাকে তার ভিতর। ছবি ও কবিতার যুগলবন্দিতে তাই একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। প্রদর্শনীতে আলোকিত হয় সেই ‘অবতল’-এর নানা নিহিত সত্য।
কৃষ্ণজিতের ছবি মূলত ডিজাইনধর্মী। এক বর্ণের সমতল প্রেক্ষাপটে ছবিগুলি রৈখিক বিন্যাসে দ্বিমাত্রিক ভাবে আঁকা। অবয়বের অভ্যন্তরেও বর্ণপ্রয়োগ একমাত্রিক। তাতে একাধিক বর্ণে গঠিত কোনও বণর্র্ছায়ার বিস্তার বা ‘টোনাল ভ্যারিয়েশন’ নেই। কাগজের উপর অ্যাক্রিলিকে আঁকা। সে দিক থেকে বলা যায় যামিনী রায়ের উদ্ভাবনেরই এক বিশেষ ধরনের রূপান্তর এখানে আমরা দেখি।
কবিতার সঙ্গে ছবির ভিত্তিগত সামান্য একটু সাযুজ্যও অনুভব করা যায়। কবিতাগুলিও ডিজাইনধর্মী। ছবির মতো কবিতাও পেয়েছে লৌকিকের নাগরিক পরিশীলন। কিন্তু কবিতা ছবির দ্বিমাত্রিকতাকে ছাপিয়ে বহু মাত্রায় বিকশিত হয়েছে। কখনওই তা ছবির বর্ণনাত্মক বাচিক অনুবাদ হয়নি। যে ছবিটির অংশবিশেষ দেখছি আমরা এই লেখার সঙ্গে, তাতে এক জন বাউল বসে আছেন একতারাটিকে অনুভূমিক ভাবে দু’হাতে ধরে। কোমরের কাছে বাঁধা আছে তালবাদ্যটি। এই প্রতিমাকল্প থেকেই কবিতায় উঠে আসে বাউলের ব্যাপ্ত দর্শন। প্রথম কয়েকটি লাইন পড়ি এ রকম
‘শরীর ধারণ করে আছি
ত্রিবেণীর গূঢ় রসধারা
মাঝে মাঝে নদীর অলক্ষ্য গাঙে
বয়ে যায় জোয়ারের পানি।’
শরীর কী ভাবে ধারণ করে জীবনের স্রোতধারা তারই সূক্ষ্ম ইঙ্গিত এখানে। কবিতা ও ছবিতে চলে এ রকমই পারস্পরিক ভালবাসার খেলা। |
|
|
|
|
|