নথি বলছে, কর মেটানো হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে ব্যাঙ্কে টাকা জমার চালান মজুত। অথচ হিসেব বলছে, সরকারের ঘরে সেই অর্থ জমা পড়েনি।
পড়বে কী করে? চালানই যে ভুয়ো! ব্যাঙ্কের সিল, মায় রিসিভিং ক্লার্কের সই সমেত পুরোটাই নকল! ব্যাঙ্কের খাতাতেও এমন কোনও জমার এন্ট্রি নেই!
মূল্যযুক্ত কর (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স, সংক্ষেপে ভ্যাট) ফাঁকির এ হেন কিছু ঘটনা সম্প্রতি ধরা পড়েছে রাজ্য অর্থ দফতরে। অর্থ-কর্তারা তড়িঘড়ি তদন্তও শুরু করেছেন। পাঁচটি ব্যবসায়ী সংস্থার (পরিভাষায় ভা্যট-ডিলার, অর্থাৎ যাদের ভ্যাট- রেজিস্ট্রেশন রয়েছে) বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে পুলিশে এফআইআর করেছেন রাজ্যের বাণিজ্য-কর কমিশনার। দফতরের দাবি, সংস্থাগুলো যে ভুয়ো চালান মারফত কোটি টাকার বেশি ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে, বাণিজ্য-কর অফিসারদের হাতে তার প্রাথমিক প্রমাণ এসেছে। বস্তুত হাতে-হাতে (ম্যানুয়ালি) কর জমা দেওয়ার পদ্ধতির মধ্যেই দুর্নীতির উৎস লুকিয়ে আছে বলে কর্তারা মনে করছেন।
এবং এরই প্রেক্ষাপটে অর্থ-আধিকারিকদের একাংশের আশঙ্কা, এ হিমশৈলের চূড়া মাত্র। তাঁরা ভয় করছেন, পাঁচটি সংস্থাকে নির্দিষ্ট করা গেলেও জালিয়াতির শিকড় হয়তো আরও গভীরে, যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন লোক। অর্থ-সচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে লেখা বাণিজ্য-কর কমিশনার বিনোদ কুমারের চিঠিতেও তার প্রতিফলন। ভ্যাট ফাঁকির ঘটনা বিশদে জানিয়ে গত ৮ অক্টোবরের ওই চিঠিতে (মেমো নং ৫৪১/সি) কমিশনার লিখেছেন, ‘আপাতত পাঁচটি সংস্থার নকল চালান আমরা ধরতে পেরেছি। তবে আমার ধারণা, এর পিছনে রয়েছে বড়-সড় চক্র, যাদের হাত দিয়ে কোটি কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি পড়ছে। এফআইআর করে পুলিশকে বলা হয়েছে তদন্ত করতে। ব্যাঙ্কের সঙ্গেও যোগাযোগ করছি।’ চিঠির বক্তব্য: অর্থ দফতরের তরফে এ বার রির্জাভ ব্যাঙ্ককেও ব্যাপারটা জানানো দরকার। সেই সঙ্গে আরও বিশদ তদন্ত প্রয়োজন। নচেৎ সরকারের প্রাপ্য টাকা আদায় করা যাবে না। |
আদায়ের পদ্ধতি-ভাগ |
অর্থবর্ষ |
ই-পেমেন্ট |
ম্যানুয়াল |
• ২০১০-১১ |
৯৯৩৮.২৮ |
৩৪৩০.১৬ |
• ২০১১-১২ |
১২৪৭৭.৬৮ |
৩৫০১.৩৮ |
• ২০১২-১৩ |
১৬৫৯১.০৮ |
১৯৫০.৮৮ |
* ভ্যাট জমার পরিমাণ, কোটি টাকায় |
|
নিজের অভিমত সচিবকে লিখিত ভাবে জানালেও বিনোদ কুমার ‘কেলেঙ্কারি’ প্রসঙ্গে কিছু বলতে রাজি হননি। মুখে কুলুপ এঁটেছেন হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীও। অর্থ দফতরের এক কর্তার অবশ্য স্পষ্ট মন্তব্য, “যেটুকু নজরে এসেছে, সেটুকুই যথেষ্ট উদ্বেগের। তাই ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভ্যাট জমা বন্ধ করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। জালিয়াতি রুখতে ব্যবসায়ীদের বলা হতে পারে গভর্নমেন্ট রিসিভ পোর্টাল (গ্রিপস) মারফত অনলাইনে ভ্যাট জমা দিতে।”
তবে তার আগে সরকারের নতুন পরিকল্পনা সম্পর্কে রির্জাভ ব্যাঙ্ককে অবহিত করা জরুরি বলে জানিয়েছেন কর্তাটি। সরকার কি সামগ্রিক তদন্তের কথা ভেবেছে?
আধিকারিকের জবাব, “আপাতত পাঁচ সংস্থার বিরুদ্ধে বাণিজ্য-কর কমিশনারের দাখিল করা অভিযোগ নিয়ে কলকাতা পুলিশ তদন্ত করছে। দরকারে সিআইডি হবে। যে সব ব্যাঙ্কের নকল চালান হাতে এসেছে, তাদের সঙ্গেও কথা বলা হবে। সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখব।” শুক্রবার অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “আগে ভ্যাটের পুরোটা ম্যানুয়ালি আদায় হতো। ই-পেমেন্ট চালু হওয়ার পরে বেশিটাই অনলাইনে জমা পড়ে, হাতে-হাতে জমা হয় দু’হাজার কোটির মতো। ফলে এখন কেলেঙ্কারির সুযোগ কম।” শীর্ষ কর্তাটির আরও দাবি, “তবু আমরা সতর্ক রয়েছি। তাই জাল চালান ধরা পড়ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা কেউ ছাড় পাবেন না। কোনও চক্র লুকিয়ে থাকলেও আমরা টেনে বার করব।”
ভ্যাট জমায় জালিয়াতি হচ্ছে কী ভাবে?
বাণিজ্য-কর সূত্রের খবর: পশ্চিমবঙ্গে ভ্যাট-তালিকায় আড়াই লক্ষাধিক নাম আছে। এই ‘ভ্যাট-ডিলার’দের মধ্যে যাদের প্রদেয় অঙ্ক মাসে দু’লাখ টাকার বেশি, তাদের বাধ্যতামূলক ভাবে ই-পেমেন্ট করতে হয়। মানে, তাদের কর অনলাইনে (গ্রিপস মারফত) ট্রেজারিতে জমা পড়ে। কিন্তু প্রদেয় অঙ্ক দু’লাখের কম, এমন সব ছোট ব্যবসায়ী এখনও ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই চালান ভরে ব্যাঙ্কে ভ্যাট জমা দেন। ব্যাঙ্ক তা সরাসরি ট্রেজারিতে পাঠিয়ে দেয়। এবং কেলেঙ্কারিটা এখানেই হয়েছে বলে প্রশাসনের দাবি। কী রকম?
অর্থ-সূত্রের ব্যাখ্যা: অভিযুক্ত পাঁচ সংস্থা বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের নকল চালান সরাসরি ভ্যাট-রিটার্নে দেখিয়ে দিয়েছে। সেগুলোর মাধ্যমে ব্যাঙ্কে কোনও টাকা জমা পড়েনি। অথচ ব্যাঙ্কের সিল-সই জাল করে প্রমাণ করতে চাওয়া হয়েছে যে, টাকা জমা পড়েছে। যেমন, একটি সংস্থা তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কলকাতাস্থিত তিন শাখার (একটি ব্যাঙ্কের ইন্ডিয়া এক্সচেঞ্জ প্লেস শাখা, একটির কলকাতা মেন ব্রাঞ্চ, একটির ব্রেবোর্ন রোড) নকল চালান রিটার্নে দেখিয়েছে, যার মোট অঙ্ক ৬৯ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা। দ্বিতীয় সংস্থা এ ভাবে ২৬ লক্ষ ৭৯ হাজার টাকার জালিয়াতি করেছে। উল্লেখ্য, দু’টি ক্ষেত্রেই জড়িয়েছে একটি ব্যাঙ্কের ইন্ডিয়া এক্সচেঞ্জ প্লেস শাখাটির নাম। বাকি তিন সংস্থার কর ফাঁকির পরিমাণ যথাক্রমে ১৩ লক্ষ ২৫ হাজার, ৩ লক্ষ ৭২ হাজার ও ১ লক্ষ ৮১ হাজার। শোষোক্ত সংস্থা একটি ব্যাঙ্কের হাওড়া শাখার ভুয়ো চালান রিটার্নে দেখিয়েছে, অভিযোগ।
জালিয়াতি ধরা পড়ল কী করে?
বাণিজ্য-করের কর্তারা জানাচ্ছেন, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ফি বছর অন্তত তিন লক্ষ ভ্যাট-চালান রিটার্নে জমা পড়ে। অথচ এত নথি খুঁটিয়ে যাচাই করার মতো পরিকাঠামো সরকারের নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা তার ফায়দা লুটছে। এ বার নেহাত কিছু সন্দেহ হওয়ায় কিছু চালান সম্পর্কে ট্রেজারিতে খোঁজ-খবর করা হয়েছিল। তাতেই দুর্নীতির হদিস মিলেছে। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাঙ্কে টাকা জমা পড়ার সাত দিনের মধ্যে তা ট্রেজারিতে চলে যাবে। ব্যাঙ্ক থেকে চালান এলেই তার উপরে পড়ে যাবে ট্রেজারি ভাউচার (টিভি) নম্বর, যা বুঝিয়ে দেবে সেটি ব্যাঙ্ক মারফত এসেছে, এবং সেই টাকা কোষাগারে জমা হয়েছে। কিন্তু এই পাঁচ সংস্থার পেশ করা চালানের হদিস ট্রেজারিতে মেলেনি, সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের শাখাতেও তার খোঁজ নেই। তখনই বোঝা যায়, কোনও কর জমা না-দিয়ে নকল চালান দাখিল করা হয়েছে।
এ ভাবে আরও কত টাকার কর ফাঁকি পড়ে থাকতে পারে?
কোনও আন্দাজ?
অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার জবাব “এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে বাণিজ্য-কর কমিশনারের চিঠির ইঙ্গিত, বহু কোটির ফাঁকি হয়ে থাকলেও কিছু করার নেই।” বাণিজ্য-কর বিভাগও সিঁদুরে মেঘ দেখছে। “যে ভাবে ম্যানুয়ালি প্রায় দু’হাজার কোটির কর আদায় হয়, সেখানে সমস্ত চালান পরীক্ষা করলে হয়তো কেঁচো খুড়তে কেউটে বেরোবে!”—মন্তব্য এক অফিসারের। |