মেট্রো রেলে কাটা পড়ে এক মহিলার মৃত্যু। তার জেরে ঘণ্টাখানেক মেট্রো বন্ধ। ট্রেন চালু হওয়ার পরে স্টেশনে নামতে গিয়ে ভিড়ের চাপে আহত বহু যাত্রী। মঙ্গলবার ভরা অফিসটাইমে এই ঘটনা পরম্পরার সাক্ষী রইল শহর।
মেট্রো সূত্রে খবর, কালীঘাট স্টেশনে মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে সকাল পৌনে দশটা নাগাদ। ফলে বিঘ্নিত হয় মেট্রো চলাচল। যা স্বাভাবিক হতে বেজে যায় পৌনে ১১টা। তখন ভরা অফিসের সময়। এক ঘণ্টা ট্রেন না থাকায় যাত্রীদের ভিড়ে মেট্রোয় তখন দমবন্ধকর পরিবেশ। এই অবস্থায় দু’দিক থেকে দু’টি ট্রেন প্রায় একই সময়ে এসে পৌঁছয় চাঁদনি চক স্টেশনে। ট্রেন থেকে নামা নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে চলতে থাকে হুড়োহুড়ি। আর তার জেরেই দিনের দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি ঘটে যায় মেট্রোয়।
ভিড়ের চাপে চলমান সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান মধ্যবয়সী এক মহিলা। ভারসাম্য রাখতে না পেরে তার উপরে গিয়ে পড়েন আরও কয়েক জন যাত্রী। সিঁড়িটি তখনও চলছে। লোহার সিঁড়িতে পড়ে মাথা ফেটে যায় ওই মহিলার। আহত হন আরও কয়েক জন। পরে যাত্রীদের চেঁচামেচিতে চলমান সিঁড়িটি বন্ধ করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে মেট্রোর সিঁড়িতে জমে রয়েছে চাপ চাপ রক্ত।
আহত ওই মহিলার নাম অঞ্জু বর্মণ। বাড়ি নিউ আলিপুরে। তাঁর মাথায় ১৩টি সেলাই পড়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, চলমান সিঁড়ির খাঁজকাটা লোহার পাতে লেগে অঞ্জুদেবীর মাথায় একাধিক গভীর ক্ষত হয়েছে। এ ছাড়াও বহু ক্ষতচিহ্ন রয়েছে তাঁর সারা শরীরে। |
ক্ষতবিক্ষত যাত্রী অঞ্জু বর্মণ। মঙ্গলবার, চাঁদনি চক স্টেশনে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী। |
ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, যে ভাবে এ দিন চলমান সিঁড়িতে ওঠা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়েছিল, তাতে দুর্ঘটনাটি আরও বড় আকার নিতে পারত। ভারসাম্য রাখতে না পেরে অঞ্জুদেবীর উপরে পড়ে গিয়েছিলেন অফিসযাত্রী রজত ধর। লোহার খাঁজে লেগে তাঁরও হাত-পা ছড়ে গিয়েছে। সারা গায়ে কালশিটের দাগ। এ সবের মধ্যে এক যাত্রীই চলমান সিঁড়িটি বন্ধ করে দেন। “না হলে যে কী হত,” তা ভেবেই আতঙ্কিত রজতবাবু।
মেট্রো রেলে আত্মহত্যার ঘটনা নতুন নয়। এমন ঘটনার পরে প্রতিবারই বহুক্ষণ বন্ধ থাকে মেট্রো পরিষেবা। এ দিনও তা-ই ছিল। কিন্তু এ দিন চাঁদনি চক স্টেশনে যা ঘটল, মেট্রো রেলের ইতিহাসে তার নজির নেই বলেই জানাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।
মেট্রো সূত্রে জানানো হয়েছে, অফিসের ব্যস্ত সময়ে দু’দিক থেকে দু’টি ট্রেন একসঙ্গে চলে এলে চাঁদনি চক স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম থেকে স্মার্ট গেটে পৌঁছনোর চলমান সিঁড়িটি বন্ধই রাখা হয়। দুর্ঘটনা রোধেই এই ব্যবস্থা বলে জানাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার পরিস্থিতি ছিল আরও ঘোরালো। কালীঘাট স্টেশনে পৌনে ১০টা নাগাদ কবি সুভাষগামী একটি ট্রেনের নীচে কাটা পড়েন বেহালার রায়বাহাদুর রোডের বাসিন্দা তনুশ্রী কর (৪৭) নামে এক মহিলা। যার জেরেই বিঘ্নিত হয় মেট্রো চলাচলে। দমদম থেকে ময়দান ও কবি সুভাষ থেকে মহানায়ক উত্তমকুমার (টালিগঞ্জ) পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করে। যতক্ষণে পরিষেবা পুরো স্বাভাবিক হয় ততক্ষণে সব স্টেশনেই জমে গিয়েছে বহু যাত্রীর ভিড়।
এ দিন ঠিক কী ঘটনা ঘটেছিল চাঁদনি চক স্টেশনে?
আহত অঞ্জুদেবী কোনওরকমে বলেন, “কালীঘাট থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম। প্রচণ্ড ভিড় ছিল। কিন্তু তাতে সমস্যা হয়নি। বিপত্তি হল এসকালেটরে উঠতেই। দু’পা এগিয়েই বুঝতে পারলাম, ক্রমশ যেন পিছিয়ে যাচ্ছি। এক সময়ে সামলাতে না পেরে হেলে পড়ে গেলাম। আমার উপরে এসে পড়লেন আরও কয়েক জন। তার পরে আর কিছু মনে নেই।”
রক্তাক্ত অবস্থাতেই বেশ কিছুক্ষণ প্ল্যাটফর্মে পড়েছিলেন অঞ্জুদেবী। তিনি বলেন, “জ্ঞান ফিরতে দেখি প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে পড়ে আছি। মাথা, হাত-পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম রক্ত বেরোচ্ছে। কেউ তুলছেও না। অনেকক্ষণ পরে কয়েক জন যাত্রী আমায় ধরাধরি করে উপরে নিয়ে যান।” তাঁরাই অঞ্জুদেবীর কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে খবর দেন তাঁর ছেলে সৌরভকে। ছেলে এসে হাসপাতালে নিয়ে যান তাঁকে।
চলমান সিঁড়িতে অঞ্জুদেবীর ঠিক পিছনেই ছিলেন টালিগঞ্জের বাসিন্দা রজতবাবু। অনেকক্ষণ মেট্রো বন্ধ থাকায় চাঁদনি চকে অফিসে পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাই বাধ্য হয়েই উঠেছিলেন ভিড় ট্রেনটিতে। রজতবাবু বলেন, “সিঁড়িতে পা দেওয়া মাত্র শুনতে পেলাম উপর থেকে কেউ চিৎকার করে উঠতে বারণ করছেন। কিন্তু ততক্ষণে সিঁড়িতে পা দিয়ে ফেলেছি। নামার উপায় নেই। এ দিকে, উপরেও জায়গা নেই। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে আছি রেলিং। মনে হচ্ছিল ছিটকে পড়ে যাব যে কোনও সময়ে। খাঁজকাটা সিঁড়ির সঙ্গে পায়ে ঘষা লাগছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। হঠাৎ নীচে পড়ে গেলেন এক মহিলা। ভার সামলাতে না পেরে এক সময়ে তাঁর উপরে পড়ে গেলাম আমিও। হাত তখনও রেলিংয়ে। আশপাশে আরও কয়েক জনকে পড়ে যেতে দেখলাম।”
মাত্র কয়েক মুহূর্ত। এর পরেই কোনও যাত্রী বন্ধ করে দেন সিঁড়িটি। রজতবাবু বলেন, “ওই কয়েকটা মুহূর্তকেই যেন মনে হচ্ছিল অনেকটা সময়। আমি কোনও দিনও এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি।”
কেন এ ভাবে চলমান সিঁড়িতে আটকে পড়লেন সকলে?
রজতবাবুই ব্যাখ্যা দিলেন ঘটনাটির। তিনি বলেন, “সবগুলি স্মার্ট গেট কাজ না করায় যাত্রীরা আটকে পড়েছিলেন উপরে। দু’টি ট্রেনের যাত্রীর ভিড়ে স্মার্ট গেটের লাইন এগোচ্ছিল না। সব ক’টি গেট খোলা থাকলে এমনটা হত না।” ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরাও মেনে নিয়েছেন রজতবাবুর ওই যুক্তি। এক নিত্যযাত্রীর বক্তব্য, অফিস টাইমে দু’টি ট্রেন কাছাকাছি সময়ে ঢুকলে এত ভিড় হয় যে প্ল্যাটফর্ম থেকে স্মার্ট গেট পর্যন্ত চলমান সিঁড়ি বন্ধ রাখতে হয়। এ দিন এক দিকে যেমন খুব ভিড় ছিল, তেমনই বেরোনোর একটি স্মার্ট গেট বিকল ছিল। এই অবস্থায় কেন চলমান সিঁড়ি চালু রাখা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বহু যাত্রীই।
মেট্রো-কর্তৃপক্ষ অবশ্য ওই দুর্ঘটনার দায় নিচ্ছেন না। উল্টে সব দায় চাপিয়ে দিয়েছেন যাত্রীদের উপরেই। তাঁদের বক্তব্য, যাত্রীদের আরও সচেতন হতে হবে। সকলে একসঙ্গে যেতে চাইলে ধাক্কাধাক্কি হবেই। এক ট্রেনে না উঠে পরের ট্রেনে আসতে পারতেন অনেকেই। এমন অবস্থা হয়েছিল যে কামরার দরজা বন্ধ হবে কি না, তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন মেট্রো-কর্তৃপক্ষ। |