|
|
|
|
যাওয়া নেই ফেরা আছে
মৃত্যুই শেষ কথা নয়। অন্য ভাবেও বেঁচে থাকা যায়। ছবির আসল বার্তা এটাই। লিখছেন সংযুক্তা বসু। |
“আসব আর এক দিন আজ যাই...”
আশা ভোঁসলের এই লাস্যভরা গানের কলি নিয়ে ছবির নাম ‘আসব আর এক দিন।’
নাম শুনলে মনে হয় হয়তো বা আপাদমস্তক একটা রোম্যান্টিক ছবি।
ছবি শুরুও হয় প্রেমের স্বরলিপিতে। গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রী স্বস্তিকা-আবির প্রেমে পড়েন। সেই সূত্রে ছবিতে আসে বাঙালি-পঞ্জাবির বিবাহ দৃশ্য। খুব হইহুল্লোড় নাচগান। অন্য দিকে স্বস্তিকার ভাইপো কলেজ পড়ুয়া গৌরব চক্রবর্তীর সঙ্গে ঋধিমা ঘোষের নাছোড় প্রেমও আছে। এ পর্যন্ত ছবিটা কেবল মার্জিত উপভোগ্য বিনোদন।
তা হলে নাম ‘আসব আর একদিন’ কেন? এইখানেই অভিজিৎ দাশগুপ্ত পরিচালিত এ ছবিতে জমে ওঠে নাটক। এবং সেই নাটকই ছবিটাকে আর এক উচ্চতায় নিয়ে যায়। বিয়ের পর আবির সিরোসিস অব লিভারে আক্রান্ত হন। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। চিকিৎসকেরা লিভার প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। কিন্তু কে দেবে এই দুষ্প্রাপ্য শরীরযন্ত্র? পরিচালক গল্পের অলিগলি পেরিয়ে রোম্যান্টিক মুহূর্ত থেকে চলে যান সিরিয়াস একটা টার্নিং পয়েন্টে। |
|
নতুনত্ব এখানেও যে ছবির পুরো গল্পটাই দেখানো হয়েছে বা বলা হয়েছে ঋধিমার দৃষ্টিভঙ্গিতে, তাঁর তরুণ মনের ভাবনায়। সে তো ভালবেসেছিল গৌরবকে। সেই গৌরবকে, ছবিতে যার নাম আনোয়ার। গরিব মুসলিম পরিবারে জন্ম এবং মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ঠাঁই হয় রূপা গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর স্বামী অরিন্দম শীলের বাড়িতে। তাঁদের গভীর ভালবাসায় বড় হলেও গৌরব ওরফে আনোয়ার ভুলতে পারে না অতীত। কিন্তু সব বিভ্রম দূর হয়ে যায় দুর্ঘটনায় তাঁর মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যাওয়ার পর।
মরণোত্তর দেহদান নিয়ে মাঝে মাঝে প্রচার হলেও মানুষ এখনও স্বাভাবিক ভাবে ভাবতে পারেন না যে মৃত্যুর পর তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটাছেঁড়া করে অন্য মানুষের শরীরে বসানো হবে। ‘আসব আর এক দিন’য়ের মিষ্টি প্রেমের গল্পের পাশাপাশি এসে পড়ে মরণোত্তর দেহদানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও। আজকের পৃথিবীতে আধুনিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিপদে ডাক্তারেরা এর প্রয়োজন অনুভব করছেন কিন্তু জনগণ সে ভাবে সচেতন নন। সেই সচেতনারই স্পর্শ দিতে চেয়েছেন এ ছবির গল্পকার কল্যাণ বসু, যিনি নিজেও একজন চিকিৎসক। মানুষে-মানুষে আত্মীয়তা কেবল রক্তের সম্পর্কের বাঁধনেই বাধা থাকে না। একজন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে আর এক জনকে বাঁচিয়ে তোলার মধ্যেও গ্রন্থি বাঁধতে পারে আত্মীয়তা---এই বার্তাই ‘আসব আর একদিন’-এর শেষ কথা। চলে গিয়ে ফিরে আসা যায়, অন্য অবয়বে, অন্য ভাবে।
চেনা ছকের গল্প হয়েও এখানেই স্বতন্ত্র একটা রূপ নেয় এ ছবি। হয়তো মনে পড়বে বহু দিন আগে তৈরি ‘অনুরাগ’ বা ‘সাহেব’ ছবির কথা। এই দুটি ছবিরও বিষয় ছিল অনেকটা এই রকম। কিন্তু তখন মরণোত্তর দেহদান নিয়ে এত সোচ্চার হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই সময়ের প্রেক্ষিতে এ ছবির বক্তব্যবিষয় বেশ জোরালো হয়ে ওঠে।
ভাল ছবি হয়ে ওঠার সব রসদই মজুদ। কিন্তু বাদ সেধেছে কিছুটা চিত্রনাট্যের টাইমিং সেন্স। হঠাৎ করেই গল্পটা তাড়াহুড়োয় শেষ হয়ে যায়। দর্শককে আর একটু ভাবার ‘স্পেস’ দিলে ভাল হত। ছবি একটু বাড়তে পারত। গৌরবের মায়ের চরিত্রে রূপার গভীর মননের সংযমী অভিনয় যথারীতি ছবির মূল সুরে ধরে রাখে একটা স্থিতধী ভাব। পরদায় প্রথমবার স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়-আবির চট্টোপাধ্যায় জুটি স্বতঃফুর্ত। গৌরব ও ঋধিমাও জমিয়ে দেন। স্বপ্ল পরিসরেই উজ্জ্বল অরিন্দম শীল, অলকানন্দা রায়। ঋধিমার গানের অডিশনের দৃশ্যে পণ্ডিত রাশিদ খান, তবলাশিল্পী পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, নায়িকা গার্গী রায় চৌধুরী ও বাচিকশিল্পী রায়া ভট্টাচার্যের উপস্থিতি বেশ চমকপ্রদ। ‘চন্দ্রবিন্দু’র গান ও সুরারোপ শ্রুতিমধুর। ঠিকঠাক বিজ্ঞাপিত হলে মানুষের মনে থাকত। কাহিনির পেলব জায়গাগুলোতে বিশেষ করে ভাল লাগে উস্তাদ রাশিদ খানের বন্দিশ এবং শেষ কালে রূপার দরাজ গলায় গাওয়া ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু,’ গানখানা। |
|
|
|
|
|