চিনে সম্প্রতি যে গুরুতর বিচার-কুনাট্যটি ঘটিয়া গেল, অনেক অর্থেই তাহা নজিরবিহীন। গণপ্রজাতন্ত্রী চিনে কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য, দক্ষিণপশ্চিম চিনের চংকিং প্রদেশের প্রাক্তন প্রধান নেতা, একদা-শীর্ষনেতৃত্বের দাবিদার বো জিলাই-কে কারান্তরিন করা হয় গত বত্সর। তাঁহার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। গত সেপ্টেম্বরে শানডং প্রদেশের স্থানীয় আদালতের রায়ে তাঁহার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হইলে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে উচ্চতর আদালতে আপিল-পরবর্তী বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এত বড় মাপের নেতার এমন বিচার সে দেশে বেশি দেখা যায় নাই। দ্বিতীয়ত, সেই ১৯৮১ সালে প্রবাদপ্রতিম মাও জে দং-এর বিধবা স্ত্রী জিয়াং-কিং-এর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের হত্যালীলার অভিযোগে আনীত মৃত্যুদণ্ডের পর এই প্রথম সম্মুখসারির কোনও রাজনৈতিক নেতা মৃত্যুদণ্ড পাইলেন। তৃতীয় একটি কারণও আছে। চিনে সাধারণত যেমন সমস্ত রাজনৈতিক মামলাই নমো-নমো করিয়া কোনও ক্রমে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সারা হইয়া যায়, এ বারও তেমন হইবারই কথা ছিল। কিন্তু দেখা গেল, বাদীপক্ষের আয়োজন ও আপিল নেহাত ফেলনা নহে এবং ঘণ্টাখানেকের পরিবর্তে পাঁচ দিন ধরিয়া চলিল উকিলি বাদানুবাদ। শেষ পর্যন্ত অবশ্যই সরকারি পক্ষেরই জয় এবং বো জিলাই-এর আজীবন কারাদণ্ড বহাল। তবে, ফলাফল যাহাই হউক, বো জিলাই-মামলাটি অবশ্যই অতি বিশিষ্ট, সাড়ে তিন দশকের ইতিহাসে আর কোনও মামলা সে দেশে এত গুরুতর হইয়া উঠে নাই।
বো জিলাই-এর অতীত রাজনৈতিক ক্যারিসমা ও খ্যাতিই সম্ভবত এই গুরুত্বের কারণ। এত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যে পরিমাণ দক্ষতার সঙ্গে তাঁহার পক্ষ হইতে অভিযোগসকল খণ্ডন করা হইল, তাঁহার স্ত্রী-র বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সাহেব-হত্যার অভিযোগের সহিত তাঁহার নিজের সম্পূর্ণ যোগহীনতা এবং নিজের সর্বোচ্চ সহকারীর মার্কিন দেশে পলায়নের বিষয়ে তাঁহার অজ্ঞতার দাবি তোলা হইল, তাহাতে এক সময় মনে হইতেছিল, মামলার রায় ঘুরিয়া যাওয়াও অসম্ভব নহে। শেষ অবধি অবশ্য রাষ্ট্রের ধ্বজাই উড়িল। তবে ধাঁধা থাকিয়া গেল। এই যে গুরুতর রাষ্ট্রবিরোধিতার মামলাতেও বাদীপক্ষকে এমন ভাবে লড়াই করিতে দিবার সুযোগ, ইহা তো চিনে প্রত্যাশিত নহে, স্বাভাবিক তো নহেই। কেন এই ‘নিরপেক্ষ’ বিচারের বিভ্রম সৃষ্টির প্রচেষ্টা? কেন বেজিং-এর সর্বোচ্চ স্তর হইতে প্রাদেশিক স্তরে সংঘটিত একটি মামলার প্রতি এত প্রবল মনোযোগ? চিন বিষয়ে কোনও অনুমানই সহজ নহে, বিশেষত চিনা রাজনীতির আবর্ত বিষয়ে অনুমান তো নহেই। এই স্বীকৃতি-সহযোগে একটি অনপমানের কথা এ বার বলা যায়: অপরাধ-রাজনীতি-চক্রের বিরুদ্ধে এক কালের প্রধান সংগ্রামী এই পলিটব্যুরো নেতার গ্রহণযোগ্যতা এখনও চিনা কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের নিকট যথেষ্ট, সম্ভবত সর্বক্ষমতাময় সাত-সদস্য-বিশিষ্ট পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছেও বেশ বেশি। সেই অংশটিকে তুষ্ট (অন্তত অ-রুষ্ট) রাখিবার উদ্দেশ্যেই সম্ভবত এই বিভ্রম-নাট্যের পরিকল্পিত অবতারণা।
সেই সাময়িক বিভ্রমের শেষে চূড়ান্ত ক্ষমতার জয়ও পরিকল্পিত রণনীতি। মামলার শেষ পর্বে আপিলটিকে যে ভাবে রণহুঙ্কারের প্রাবল্যে মোকাবিলা করা হইল, তাহাও সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। বো জিলাই-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রকার ও আকার যাহাই হউক না কেন, তাহার পিছনে যে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের রাজনৈতিক অভিসন্ধি সতত কার্যকর থাকিয়াছে, তাহা সমগ্র ঘটনার মধ্যেই স্পষ্ট। দলতান্ত্রিক স্বৈরশাসন কোনও প্রতিস্পর্ধা তো সহ্য করেই না, নেতৃত্বের স্তরে কোনও প্রতিযোগিতাও সহ্য করে না। বো জিলাই সম্ভবত সেই সহ্যসীমার অতীত হইয়াছিলেন। |