হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার উপায় নেই। শনিবার সকালে অসুস্থ মাকে নিয়ে আর জি কর হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সল্টলেকের বাসিন্দা উত্তম দাস। জল থইথই কলকাতায় একে তো ট্যাক্সি নেই, আর যা-ও বা দু’একটা চলেছে, আকাশছোঁয়া ভাড়া হেঁকেছেন চালকেরা। অগত্যা অফিসের গাড়ি ডেকে কোনও রকমে মাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছলেন তিনি।
অন্য দিকে, হাওড়ার জল-পথ বেয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে চেপেও হাসপাতালে পৌঁছতে গিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হল বালির কাজল ঘোষকে। সালকিয়ার টি এল জায়সবাল হাসপাতালের খানিক আগে জি টি রোডে জমা জলে আটকে পড়ে গাড়িটি। শেষে চড়া ভাড়ায় ভ্যানরিকশা করে তাঁকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছন বাড়ির লোকেরা।
শুক্রবার রাত থেকে লাগাতার বৃষ্টির জেরে শনিবার এ ভাবেই নানা ভাবে দুর্ভোগের শিকার হতে হল কলকাতা ও হাওড়ার বাসিন্দাদের। রাস্তায় সরকারি ও বেসরকারি বাসের সংখ্যা ছিল অন্য দিনের চেয়ে বেশ কম। ট্যাক্সিও তেমন চোখে পড়েনি। অটো চলেনি বহু রুটে। ফলে ধর্মতলা চত্বরে বাসের অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজতে হয়েছে অনেককেই। রাস্তায় ট্যাক্সি কম থাকায় হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশনের প্রি-পেড বুথে লম্বা লাইন পড়ে ট্রেনযাত্রীদের। ট্যাক্সি না পেয়ে বহু যাত্রীকে কাগজ-কাঁথা পেতে বসে থাকতে হয় হাওড়া স্টেশনে। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়তে থাকায় স্টেশনের ভিতরে ভিড় এমন বেড়ে যায় যে, এক সময়ে রেলপুলিশ এবং আরপিএফের জওয়ানেরা ভিজে ভিজেই ট্যাক্সি জোগাড় করে দেন যাত্রীদের। |
অটো চলতে পারছে না। দেখা নেই বাসেরও। এ ভাবেই মেট্রো স্টেশনের পথে নিত্যযাত্রীরা।
শনিবার, পাতিপুকুর এলাকায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী। |
এর সুযোগ নিয়েছেন এক শ্রেণির ট্র্যাক্সিচালক। শহরে জল জমার কারণ দেখিয়ে কোথাও তিন গুণ, কোথাও বা চার গুণ বেশি ভাড়া দাবি করেছেন তাঁরা। কিন্তু সরকারি বাস কেন কম বেরিয়েছিল? এক পরিবহণকর্তা বলেন, “প্রবল বৃষ্টিতে বহু কর্মী সকালের দিকে ডিপোয় পৌঁছতে পারেননি। তার উপরে বিভিন্ন রাস্তায় যে পরিমাণ জল দাঁড়িয়ে ছিল, তাতে বাস বিকল হওয়ার আশঙ্কা ছিল। সেই কারণেই কম বাস নেমেছিল।” জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটস্-এর সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এমনিতেই ভাড়া বাড়েনি। তার উপরে বৃষ্টিতে কম লোকই বেরিয়েছিলেন। জলে বাস বার করে ক্ষতি বাড়াতে কে চায়?” একই সাফাই ‘বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন’-এর নেতা বিমল গুহেরও।
তুলনায় ট্রেন চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক ছিল এ দিন। লাগাতার বৃষ্টির জেরে হাওড়ার মেন ও কর্ড, শিয়ালদহের মেন, দক্ষিণ, ডানকুনি ও বনগাঁ শাখায় ট্রেন কিছুটা দেরিতে চললেও কখনওই বন্ধ হয়নি। তবে বারাসত-হাসনাবাদ শাখায় লাইনে জল জমে যাওয়ায় ও সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ হয়ে পড়ায় ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। চলেনি কেবল চক্ররেল। সকালের দিকে চালাতে গিয়ে সেই যে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন, বৃষ্টি বন্ধের পরেও লাইনে জল জমে থাকায় বিকেলেও চলেনি চক্ররেল। পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র জানান, কলকাতা স্টেশন সংলগ্ন এলাকা ও লাইনে জল দাঁড়িয়ে থাকায় এ দিন ট্রেন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুপুরের পর থেকে যে ট্রেনগুলি কলকাতায় ঢোকা-বেরোনোর কথা ছিল সেগুলিকে শিয়ালদহে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে কোনও ট্রেন বাতিল করা হয়নি বলে জানান তিনি।
রেলপথে তেমন জল না জমলেও কলকাতার বহু সড়কপথ এ দিন জলের তলায় চলে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, প্রবল বৃষ্টিতে শহরের কমবেশি ১০৮টি রাস্তায় জল ছিল। এর ফলে ই এম বাইপাস, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, রামমোহন সরণি, এ জে সি বসু রোড, শরৎ বসু রোড, শেক্সপিয়র সরণি, ডায়মন্ড হারবার রোড ও গড়িয়াহাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় যান চলাচল বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বন্ধ ছিল ওই সব রাস্তার সমস্ত দোকান। টানা বৃষ্টির কারণে ভয়াবহ আকার নেয় শহরের গলিগুলিও। পুলিশ জানাচ্ছে, কলকাতা পুরসভার সংযোজিত বহু এলাকার ঘরবাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে। আরও বৃষ্টি হতে পারে শুনে রীতিমতো আতঙ্কে জমা জলে আটকে থাকা ওই এলাকার বাসিন্দারা। পুরসভার নিকাশি বিভাগের ওএসডি অমিত রায় বলেন, “রবিবার এমন বৃষ্টি হলে রাজ্যের অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের কাছে নৌকা চাওয়া হবে।”
পুরসভা জানাচ্ছে, শহরের জমা জল বার করতে এ দিন দুশোরও বেশি পাম্প চলেছে দিনভর। সেই জল বার করা নিয়েই বিবাদে জড়িয়ে পড়েন বেহালার ১২৬ এবং ১২৮ ওয়ার্ডের দুই তৃণমূল কাউন্সিলর শিপ্রা ঘটক ও দোলা সরকার। স্থানীয় সূত্রের খবর, কোন ওয়ার্ডের জল পাম্প করে আগে বার করা হবে, তা নিয়ে প্রথমে দুই কাউন্সিলরের অনুগামীদের মধ্যে বচসা বাধে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন দুই কাউন্সিলরই। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তো দূর, অনুগামীদের পক্ষ নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তাঁরাও। ঘণ্টাখানেক পরে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে বিষয়টির মীমাংসা হয়। মেয়র তাঁদের জানান, ওই দুই ওয়ার্ডে দু’ ঘণ্টা করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পাম্প চালানো হবে।
দুর্ভোগের শিকার পূর্ব কলকাতার ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের নারকেলডাঙা মেন রোডের বাসিন্দারাও। এত দিন ওই এলাকায় জল জমলেও কিছু ক্ষণের মধ্যে তা নেমে যেত। কিন্তু এ বার অন্য চিত্র। স্থানীয় কাউন্সিলর তথা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বস্তি উন্নয়ন) স্বপন সমাদ্দার বলেন, “মেট্রোর কাজের জন্য রেল দু’টি নিকাশি নালা বন্ধ করে দিয়েছে। বদলে নতুন একটি নিকাশি নালা তৈরি করলেও তাতে বিপত্তি আরও বেড়েছে। জল বেরিয়েও ফের ফিরে আসছে ওই নালা দিয়ে।”
অতিবৃষ্টিতে নাকাল অবস্থা শহরতলিরও। এ দিন সকালেই কোথাও হাঁটু, কোথাও বা কোমর সমান জল দাঁড়িয়ে যায় দক্ষিণ দমদম, লেকটাউন, পাতিপুকুর, দমদম পার্ক, কেষ্টপুর ও বাগুইহাটির বিভিন্ন এলাকায়। উল্টোডাঙা ও পাতিপুকুর আন্ডারপাস ভোর থেকেই ছিল জলমগ্ন। অভিযোগ, জলের ভয়ে আন্ডারপাসের আগেই যাত্রীদের নামিয়ে দেন অধিকাংশ অটোচালক। ফলে বাধ্য হয়েই হাঁটুসমান জলে আন্ডারপাস পেরোতে হয়েছে নিতাযাত্রীদের। পুলিশ জানিয়েছে, কেষ্টপুর সংলগ্ন ভিআইপি রোডে একটি বেসরকারি বাসের চাকা কাদায় আটকে গিয়ে কাত হয়ে পড়লেও অল্পের জন্য যাত্রীরা বেঁচে গিয়েছেন।
রাতভর বৃষ্টিতে কার্যত ডুবে গিয়েছে হাওড়া পুর-এলাকার একাধিক ওয়ার্ডও। সবচেয়ে করুণ অবস্থা ৬, ৯, ২০ এবং ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের। সেখানে খাবার জলের কলও ডুবে গিয়েছে। জল ঢুকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু বাড়ির রান্নাবান্না। জেলা প্রশাসনের তরফে চিড়ে-গুড় ও পানীয় জলের পাউচ পাঠানো হয়েছে ওই সব এলাকায়। পরিস্থিতি এমনই যে হাওড়া পুরসভার সংযোজিত এলাকার ভূতবাগান ও পেয়ারাবাগানে নৌকো নামায় প্রশাসন। কেন এই হাল? মেয়র মমতা জায়সবাল বলেন, “এত বৃষ্টি হয়েছে যে, জল ফেলার জায়গা মিলছে না। আগে থেকেই নদী-নালা, খাল-বিল ভরে রয়েছে। তাই গঙ্গার জল কমলে শহরের জমা জল বার করা হবে।” |