রাস্তার পাশে জটলা করেছিল কয়েকজন ছেলে। দূর থেকে গাড়ি আসতে দেখেই ছেলেগুলো রাস্তার উপরে উঠে এলো। গাড়ি থামতেই চাঁদার বইয়ে খসখস পেন চালিয়ে টাকার পরিমাণ লিখে একটা হাত এগিয়ে গেল চালকের দিকে। দর কষাকষি করার চেষ্টা করলেন চালক। কিন্তু ছেলেগুলোর যে সময় নেই। পিছনে আরও গাড়ি। দাবি মতোই টাকা দিতে হল চালককে।
দুর্গাপুজোর আগে থেকে শুরু হয়েছে। কালীপুজোর মুখেও চাঁদার জুলুম অব্যাহত বিষ্ণুপুর ও বিরাই নদীর মাঝে, বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে। ট্রাক, লরি থেকে বাস, ট্রেকার চাঁদা আদায়কারীদের হাত থেকে নিস্তার নেই কারও। সাইকেল, মোটরবাইক দেখলেও তাঁদের হাত থেকে রেহাই নেই। এমনই অভিযোগ ওই রাস্তায় যাতায়াতকারী গাড়ি চালক থেকে আমজনতার। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও তাঁদের অভিযোগ রয়েছে। যদিও জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার দাবি করেছেন, শুক্রবারই বিষ্ণুপুর থেকে জোর করে গাড়ি থামিয়ে চাঁদা তোলার অভিযোগে দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। শালতোড়াতেও একই অভিযোগে একটি কালীপুজো কমিটির নামে অভিযোগ করা হয়েছে।” |
রাস্তায় যানবাহন থামিয়ে জোর করে চাঁদা আদায় করা দণ্ডণীয় অপরাধ। কিন্তু হেলদোল নেই ওই ছেলেদের। মহালয়ার আগে থেকেই বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক, বিষ্ণুপুর আরামবাগ রাজ্য সড়ক, বিষ্ণুপুর-সোনামুখী রাস্তা-সহ জেলার প্রায় গুরুত্বপূর্ণ সব রাস্তাতেই পথ আটকে চাঁদা তোলা চলছে। বিষ্ণুপুরের রেলগেট থেকে বিরাই নদীর সেতু পর্যন্ত এ দিন অন্তত ছ’টি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় করতে দেখা গিয়েছে। পথচারীদের প্রশ্ন, দিনের আলোয় এই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় চাঁদা তোলার সাহস ওদের হল কী ভাবে? ঘটনা হল এ বারই ব্যতিক্রম নয়। গত কয়েক বছর ধরে ওদের দৌরাত্ম্য চলছে। আর এতেই তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছেন পরিবহণ ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ।
বিষ্ণুপুরের কাছে এক লরি চালক বলেন, “বাঁকুড়া থেকে বিষ্ণুপুর আসার পথে অন্তত ১০টি জায়গায় কালীপুজোর চাঁদা দিতে হয়েছে। যে ভাবে ছেলেগুলো রাস্তার উপর উঠে আসে, পাশ কাটিয়ে বেরতে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কিন্তু এতজনকে চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে লাভ থাকে না।” বাঁকুড়া জেলা বাস মালিক সমিতির সম্পাদক দীপক সুকুল বলেন, “চাঁদার জুলুমের জন্য পুজোর সময় এক মাস বাস চালানো দায় হয়ে গিয়েছে। প্রতি বছরই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে দুর্গাপুজা, কালীপুজা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী পুজার আয়োজকের সংখ্যা। প্রায় প্রতি মোড়ে মোড়েই গাড়ি আটকে জোর করে চাঁদা আদায় চলছে।” বাঁকুড়া-তারকেশ্বর ও বাঁকুড়া-দুর্গাপুর রুটে তাঁর দু’টি বাস চলাচল করে। এ ছাড়া তাঁর একটি ট্যুরিস্ট বাসও ভাড়া খাটানো হয়। তাঁর কথায়, “শুধু মাত্র দুর্গাপুজোর জন্যই ওই তিনটি গাড়ি থেকে আড়াই হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছি।” তাঁর মতে, পুলিশের আরও সক্রিয়তা প্রয়োজন।
পাড়ার দাদাদের দেখাদেখি এই সংস্কৃতি রপ্ত করে ফেলেছে খুদেরাও। তাই গ্রাম-শহরের অলিতে গলিতে দড়ি ধরে পথ আটকে মোটরবাইক, সাইকেল, রিকশা চালকদের কাছ থেকেও চাঁদা তোলায় নেমে পড়েছে অনেক খুদেও। বিষ্ণুপুর শহরের মাধবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রাজু রজক বলেন, “পাড়ায় পাড়ায় বাচ্চা ছেলেরা কালীপুজা উপলক্ষে দু’টাকা, এক টাকা করে চাঁদা তুলছে। না দিলে সাইকেল আটকে রেখে দিচ্ছে। এই সব ঘটনা শহরে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।”
পুলিশ সুপার জানান, রাস্তায় যানবাহন আটকে চাঁদা তোলার অভিযোগ জামিন অযোগ্য। তিনি বলেন, “বিভিন্ন এলাকায় জোর করে চাঁদা আদায়ের বিরুদ্ধে টহল চলছে। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তবে অনেক সময়েই এ সব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করতে চান না বাসিন্দারা। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়।” বাসিন্দাদের দাবি, পুলিশ টহল দিলে অনেকে হাতেনাতে ধরা পড়বে। কমবে দৌরাত্ম্যও। |