ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ, নিজেদের কাজকর্ম সামলে একসঙ্গে ছুটি পাওয়াটাই বেশ মুশকিল। দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার জন্য তাই পুজোর ছুটিটাই একমাত্র ভরসা। অতএব, ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে মহালয়াতেই শুরু হয়ে গেল আমাদের কেরল সফর।
কেরল মানেই সবুজ। কি নেই সেখানে? সমুদ্র, পাহাড়, নদী তার সঙ্গে বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রা। আমরা শুরু করলাম কোচিন থেকে। পতুর্গীজ, ইহুদী, ইংরেজ-সহ বহু জাতি তাদের জীবনযাত্রা ও স্থাপত্যের ছাপ রেখে গিয়েছে এই উপকূলবর্তী শহরে। বোটে করে উপকূলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চুটিয়ে ঘুরলাম এক ইতিহাস সমৃদ্ধ মায়াবী শহর। স্থানীয় চিপস্, ঘরে তৈরী সুস্বাদু চকলেটও খেলাম মন ভরে। আমাদের গাইড জানালেন, কোচিন শহরেই কেরল হাইকোর্ট রয়েছে। কিন্তু কোচিন কেরলের রাজধানী নয়। দেশের অন্যান্য শহরের মত এখানেও এম জি রোড বেশ সাজানো। শহরে মেট্রো রেলের কাজও খুব শিঘ্র চালু হবে বলে শুনলাম। বিকেলে গেলাম এশিয়ার সব থেকে বড় ‘লুলু’ শপিং মলে। আকারে বলতে পারব না তবে বৈচিত্র্যে এর থেকে আমাদের কলকাতার মলগুলিও কিছু কম যায় না। |
কুমারাকমের ব্যাক ওয়াটার। |
পর দিন চললাম পাহাড়ি শহর মুন্নারে। পথে চা বাগান, নানা মশলার বাগিচা, ঝর্না আমাদের বারবার দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল নিজের অকৃপণ সৌন্দর্য্য দেখার জন্য। মুন্নার শহরটা ছোট, তবে শহর ঘিরে অপূর্ব নৈস্বর্গিক দৃশ্য ভোলার নয়। পরের দিন সকাল সকাল যাত্রা করলাম কুমারাকম। জায়গাটা ব্যাক ওয়াটার, লেক ও পাখিরালয়ের জন্য বিখ্যাত। পাহাড় থেকে নামতে নামতে দেখলাম প্রচুর রবার চাষ। বইয়ের পাতায় পড়া রবার গাছ একেবারে চোখের সামনে। মনটা ফুরফুর করে উঠছিল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নেমে এলাম সমতলে। তারপরে নৌকা করে ঘুরলাম নদীতে। নদী নির্ভর গ্রাম্য জীবন যে এত সাজানো গোছানো হতে পারে আগে দেখিনি। ব্যাক ওয়াটারে ঘুরে বেড়াবার জন্যে পেল্লাই হাউস বোটও রয়েছে। যা আমাদের দেশি বড় নৌকার পরিপাটি সংস্করণ। বিলাসি পর্যকটেরা দিব্যি এক দু’রাত কাটাতে পারেন এমনই সব ব্যবস্থা। লেকে রয়েছে বেশ কিছু দেশি বিদেশি পাখি। গাইড বললেন, ক’দিন পরে আরও অনেক পাখি আসবে। |
এবারে আমাদের কোভালামের উদ্দেশ্যে যাত্রা। দু’শো কিলোমিটার রাস্তার প্রায় পুরোটাই মালভূমি। ১৫-২০ কিলোমিটার অন্তর ছোট ছোট সাজানো আধা পাহাড়ি শহর। অদ্ভুত সব দক্ষিণী নাম। সাইনর্বোড দেখে উচ্চারন করতে করতেই শহরটা পিছনে মিলিয়ে যায়। সন্ধ্যার মুখে পৌঁছলাম তিরুঅন্তপুরম। আলো আঁধারিতে ঢাকা এক মায়াবী শহর। একেবারে শেষ প্রান্তে কোভালাম সি-বিচ। আমাদের হোটেলও লাইট হাউস বিচে। সমুদ্রের এতো কাছে হোটেল হতে পারে ধারণা ছিল না। সমুদ্রের গর্জনে গা ছমছম করতে লাগাল। সমুদ্রের ঢেউ পাহাড়ে ধাক্কা দিয়ে যে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করছে তা দেখব না ছবি তুলে রাখবো ভাবতে ভাবতেই দিন কেটে গেল। পরের দিন যথারীতি তিরুঅনন্তপুরম শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। টো টো করে ঘুরলাম মিউজিয়াম, অ্যাকোয়ারিয়াম, মন্দির, পুরানো প্রাসাদ থেকে বিধানসভা ভবন ও অন্যান্য প্রশাসনিক ভবন। শহরটা ঘুরতে ঘুরতে মনে হয় এক দিকে শান্ত নিরালা কিছু জায়গা, অন্য দিকে আধুনিক ব্যস্ততা ঘেরা এক রাজধানী।
সফর প্রায় শেষ। ফেরার আগে সকালে আরও একবার সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আরব সাগর দেখলাম। একগুচ্ছ মাছ ধরার ট্রলার ফিরছে জেটিতে।
শেষ দিন অবশ্য সকাল থেকেই বুক দুরু দুরু। টিভিতে খবরে শুনছি ভয়ঙ্কর ঝড় পিলিন আসছে ওড়িশা ও অন্ধ্র উপকুলের দিকে। ও পথেই তো ফিরব। অতএব বিধাতার কাছে প্রার্থনা যেন নিরাপদে পৌঁছতে পারি। বিধাতা শুনলেন। একটু ঘুরপথে কেরল সফর সেরে নির্বিঘ্নে কলকাতা পৌছলাম, সঙ্গে অপার তৃপ্তি।
|