শুধু সকলের আগে নয়, ধারে-কাছেও কেউ নেই। ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহে এ রাজ্যে শীর্ষে মুর্শিদাবাদ। ‘লজ্জাজনক’ এই পরিসংখ্যানের জন্য শিক্ষা, সচেতনতার অভাব এবং জেলার আর্থ-সামাজিক অবস্থাই দায়ী বলে মনে করছেন সমাজবিদরা। অনেকে আবার মনে করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ নেই বলেই এই নিয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “নাগরিক সমাজের আন্দোলন হবে কী ভাবে? মহিলাদের সমাজের অঙ্গ হিসাবেই তো গণ্য করা হচ্ছে না। পুরোটাই নবাবি মেজাজ। পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা। মেয়েদের কথা কেউ ভাবে না। মেয়েরা নিজেরাও ভাবে কি না জানি না।”
পুলিশি পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৩ সালে রাজ্যের মোট ১০০২টি ধর্ষণের নথিভুক্ত ঘটনার মধ্যে ১০৬টিই ছিল মুর্শিদাবাদের। রাজ্যের ১৯টি জেলার মধ্যে মুর্শিদাবাদ সে বার ছিল দ্বিতীয় স্থানে। তারপর থেকে ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহ জেলায় ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ২০১০ সালে রাজ্যের ৪৭৭৬টি ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহের ঘটনার মধ্যে ২৫ শতাংশেরও বেশি ঘটনা ঘটেছে মুর্শিদাবাদে। অর্থাত্ রাজ্যে প্রতি ৪টি ঘটনার মধ্যে একটিই মুর্শিদাবাদে। ২০১১ সালে মুর্শিদাবাদে ৪৩৩টি ধর্ষণের ঘটনায় ‘শিকার’ ছিল ১১৫ জন নাবালিকা। ২০১২ সালে রাজ্যে নথিভুক্ত ধষর্ণের সংখ্যা ছিল অনেক কম। মুর্শিদাবাদেও সংখ্যাটা কমে দাঁড়ায় ২৫৭। কিন্তু এই বছরেও রাজ্যের শীর্ষ স্থানে থাকা জেলার নাম মুর্শিদাবাদ। নারী নিগ্রহের অভিযোগ হয় ৬০৯টি। ধর্ষিতাদের মধ্যে ৮৫ জনের বয়স ছিল ১৫ বছরের নীচে। আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধরলে ধর্ষণের অভিযোগের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়েছে বলে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
ধষর্ণ, নারী নিগ্রহ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা জেলায় যে ক্রমশ বাড়ছে, সে কথা কবুল করেছেন মুর্শিদাবাদের জেলা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীরও। তাঁর কথায়, “বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাসের ঘটনাতেও ধর্ষণ বলেই মামলা রুজু করে পুলিশ। সেই কারণেই ধর্ষণের সংখ্যাটা এত বেশি হয়ে যায়। ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশ কখনই গাফিলতি করে না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই মামলা রুজুর পর টাকাপয়সা দিয়ে মামলা মিটিয়ে নেওয়া হয়। ফলে দোষীরা সাজা পায় না। তাই এই ধরণের ঘটনা বন্ধ করতে গেলে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি শিক্ষার বিস্তার দরকার। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে মুর্শিদাবাদ ওই দু’টো ক্ষেত্রেই বেশ পিছিয়ে রয়েছে।”
শিক্ষার নিরিখে মুশির্দাবাদ যে যথেষ্ট পিছিয়ে, তা জনগণনার পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট। পরিসংখ্যান বলছে জেলায় মোট ৭১ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ নিরক্ষর। সাক্ষরতার নিরিখে রাজ্যের ১৯টি জেলার মধ্যে মুর্শিদাবাদ রয়েছে ১৭তম স্থানে। ফরাক্কা মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম ফৈজি বলেন, “শিক্ষার অভাব তো আছেই। কিন্তু ভাল-মন্দের পার্থক্য বোঝার মতো তো জ্ঞান সকলেরই আছে। নিজের বাড়ি পরিস্কারের দায়িত্ব নিতে হবে নিজেদেরই।”
সমাজবিদদের মতে, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার জন্য সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই জেলায় নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে এত বেশি। জেলায় প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ বিড়ি শ্রমিক। বলাবাহুল্য, স্কুলের চৌকাঠ পেরনোনি অধিকাংশই। ভিন্ রাজ্যে দিনমজুরের কাজ করেন বহু মানুষ। প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে নাবালিকা বিয়ের হার অনেক বেশি। যৌনসম্পর্কে আগ্রহও ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অনেক বেশি।
এ ছাড়াও হানাহানি, হিংসা, উস্কানিমূলক ঘটনায় এগিয়ে মুর্শিদাবাদ। চোর-ডাকাত-দুষ্কৃতীদের দাপট খুব। পুলিশের রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণে অভিযুক্তদের বেশিরভাগই সমাজবিরোধী হিসাবে পরিচিত এলাকায়। পারিবারিক বা সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের জেরেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে আকছার। এখানেই চলে আসছে আইন-শৃঙ্খলার প্রসঙ্গ। পুলিশ অবশ্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় গাফিলতির অভিযোগ মানতে নারাজ। জেলার এক সরকারি আইনজীবী অশোক সাহা আবার বলেন, “ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহের ঘটনা বাড়ার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পুলিশকেই দায়ী করে লাভ নেই। বহু ঘটনা আদালতে আসার পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মিটমাট করে নেওয়া হচ্ছে। দোষীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থারও একটা পরিবর্তন দরকার। আমাদেরও ভাবতে হবে কেন অভিযোগ জানানোর পরেও সেটা মিটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।”
ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহের প্রবণতা সব থেকে বেশি বেড়েছে মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা, সুতি ও ধুলিয়ান এলাকায়। ধুলিয়ান কলেজের অধ্যক্ষ অমিত ভৌমিক বলেন, “শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব এবং দারিদ্র এর প্রধান কারণ। রয়েছে প্রশাসনিক শিথিলতাও। তাছাড়া নাগরিক সমাজ দিল্লি ও কামদুনির ঘটনায় যতটা সরব হয়েছেন মুর্শিদাবাদের কোথাও কিন্তু সেই ভাবে সম্মিলিত প্রতিবাদ চোখে পড়েনি।” জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি ওবাইদুর রহমানও মনে করেন, “আসলে নাগরিক সমাজ দুর্বল বলেই এই ধরনের
ঘটনা বাড়ছে।”
এটা মানতে হয়, কামদুনি-কাণ্ডে নাগরিক সমাজ যে ভাবে সরব হয়েছিল, সম্প্রতি ফরাক্কার বেনিয়াগ্রামে এক নাবালিৗকাকে ধর্ষণ করে খুনের পরে তার সামান্য প্রতিধ্বনিটুকুও ওঠেনি। |