স্বশাসনের অর্থ যে অপশাসন নহে, এই মৌলিক কথাটি বুঝা বোধহয় সহজ নহে। সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের সাম্প্রতিক কার্যকলাপে সেই ইঙ্গিতই রহিয়াছে। সরকারি তর্জনীর হেলনে যে সি বি আই কর্তারা ওঠাবসা করেন না, তাহা বুঝাইতে অতিরিক্ত তৎপর না হইলে কয়লাখনি-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক অভিযোগটির গতিপ্রকৃতি এমন বিস্ময়জনক হইত কি? প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট বলিল, ২০০৫ সালের ১০ নভেম্বর হিন্দালকো সংস্থার প্রধান কুমারমঙ্গলম বিড়লা ওড়িশার তালাবিরা কয়লাখনি দুইটি অন্যায্য পথে পাইয়াছিলেন। কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব পি সি পারেখও এই অভিযোগে অপরাধী হিসাবে বর্ণিত হইলেন। কুমারমঙ্গলম বিড়লার বিরুদ্ধে এফ আই আর পর্যন্ত দায়ের হইল। কিন্তু ঠিক কী নথিপত্রের ভিত্তিতে এই অভিযোগ, অপরাধটি কী প্রকার, সি বি আই তাহার কোনও কিছুই প্রকাশে প্রবল অনিচ্ছুক। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ব্যক্তিগত উদ্যোগে অন্যতম অগ্রগণ্য শিল্পপতির রক্ষণার্থে মুখ খুলিবার পর হইতে অবশ্য বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা লইয়াছে। ইতিমধ্যেই শোনা যাইতেছে, সি বি আই মামলা প্রত্যাহার করিবে, ‘আরও অনেক ক্ষেত্রের মতো’ এ ক্ষেত্রেও তদন্ত বন্ধ হইবে। কিন্তু সমস্যা তো গোড়াতেই। কীসের ভিত্তিতে এই অভিযোগ আনীত হইয়াছিল, এখনও পর্যন্ত সি বি আই তাহা স্পষ্ট করে নাই। অথচ এ ক্ষেত্রে পন্থা কেবল দুটিই: হয় স্বশাসিত সংস্থার পূর্ণ মর্যাদা লইয়া কাজ করিতে হইবে, নতুবা মানিতে হইবে সংস্থার কার্যপ্রণালী সম্পূর্ণ স্বমর্যাদায় মহীয়ান নহে। প্রথম পথটি লইতে হইলে তথ্যসাবুদের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা দরকার। এফ আই আর পর্যন্ত ঠোকা হইবে, অথচ অপরাধের প্রকৃতি বিষয়ে আগাগোড়া গোপনীয়তা বজায় রাখা হইবে, ইহা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। কোনও গণতান্ত্রিক দেশে এমন মগের মুলুক চলিতে পারে না। সরকার, বে-সরকার, আধা-সরকার: কোনও তরফেই নহে।
স্বভাবতই, যথাযথ কারণ না দর্শাইয়া কুমারমঙ্গলম বিড়লার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ শিল্পকর্তাদের বিশেষ বিরক্ত ও বিব্রত করিয়াছে। অফিসে টাকা রাখিবার বিষয়ে যে অভিযোগ, তাহাও এখনও পর্যন্ত ঠিক ভাবে দাঁড়ায় নাই। কেন তাহা আইনবিরোধী প্রতীত হইল, বোঝা যায় নাই। বাস্তবিক, দেশের অগ্রণী তদন্ত সংস্থা যদি এমন স্বেচ্ছাচারী ভঙ্গিমায় মত্তপদে বিচরণ করে, তাহা হইলে শিল্পকর্তাদের হতোদ্যম হইবার ও দেশের শিল্পোন্নতি সম্ভাবনায় ভাটা পড়িবার বিস্তর সম্ভাবনা রহিয়া যায়। সি বি আই-এর অনুযোগ, তালাবিরা খনি লইয়া সরকারি মন্ত্রক এবং বেসরকারি কোম্পানির মধ্যে অনিয়মভিত্তিক আয়োজন হইয়াছে। দুর্নীতিলাঞ্ছিত দেশের উপর মহলের দেওয়ানেওয়ার হিসাব কী ভাবে চলে, সকলেই তাহা জ্ঞাত। তাহার উপযুক্ত তদন্ত ও বিচার নিশ্চয়ই কাম্য। কিন্তু যে কোনও ব্যক্তির যে কোনও অর্জনের ক্ষেত্রকেই আবশ্যিক ভাবে দুর্নীতিময় হিসাবে ধরিয়া লওয়া চলে না। তাহা গণতান্ত্রিকও নহে, দেশের উন্নতির সহায়কও নহে।
উপর মহলই হউক, আর মধ্য বা নীচ মহলই হউক, তদন্ত পদ্ধতির পরম্পরাটি অতিশয় জরুরি। উপর মহল বলিয়া না হয় এ ক্ষেত্রে সি বি আই তদন্তপ্রণালী লইয়া এত আলোচনা হইল, অন্যান্যদের ক্ষেত্রে তো এই আলোচনার সুযোগ কিংবা অবকাশ না ঘটিবারই সম্ভাবনা। প্রশ্নটি সুতরাং বৃহত্তর। সি বি আই-এর মতো সংস্থার উপর দেশের অনেক ভার ন্যস্ত থাকে, ভবিষ্যতেও থাকিবে। সেই কারণেই একটি স্বাধীন মর্যাদাময় সংস্থা হইয়া উঠিবার দায়টি সি বি আই-এর জন্য জরুরি। দেশবাসীর আস্থার প্রশ্নটি জরুরি। এই রকম এলোমেলো পদক্ষেপ, অস্পষ্ট অভিযোগ, ক্রমাগত আগুপিছুর এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়া সে আস্থা অর্জন করা অসম্ভব। |