রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আজকের শীর্ষ বৈঠকের ফলস্বরূপ প্রস্তাবিত দু’টি নতুন পরমাণু চুল্লি ভারত পেল না ঠিকই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন সিংহের শেষ মস্কো-দৌত্যে কিন্তু যথেষ্টই আশার আলো দেখছে নয়াদিল্লি। মনমোহন-পুতিন শীর্ষ বৈঠকের পর দু’দেশ যে যৌথ বিবৃতি পেশ করল, তাতে প্রতিরক্ষা থেকে শক্তিক্ষেত্র, মহাকাশ গবেষণা থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতা এই সমস্ত ক্ষেত্রেই দু’দেশের মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়ানোর পথনির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কথায়, “রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার গভীরতা, বৈচিত্র্য এবং গতিশীলতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে এই সম্পর্ক কৌশলগত ভাবে একটি বিশেষ জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে।” |
মস্কোয় ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মনমোহন সিংহ। ছবি: রয়টার্স। |
এই ‘বিশেষ জায়গা’-রই ব্যাখ্যা রয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। কুড়ানকুলাম নিয়ে যেখানে বলা হয়েছে, “এক নম্বর পরমাণু চুল্লির কাজ নিয়ে দু’দেশই সন্তোষ প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ যাতে দ্রুত শেষ হয়, সে জন্য ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। ৩ ও ৪ নম্বর চুল্লির জন্য চুক্তির কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করার জন্য দু’দেশের সংশ্লিষ্ট অফিসারদের নির্দেশে দেওয়া হয়েছে।”
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন সংক্রান্ত কিছু বাধার কারণে কুড়ানকুলামের ৩ এবং ৪ নম্বর ইউনিট নিয়ে কোনও চূড়ান্ত চুক্তি করা সম্ভব হল না মনমোহনের এই সফরে। কিন্তু এ জন্য যাতে হতাশা না তৈরি হয়, সে দিকে যথেষ্ট নজর দিয়েছে সাউথ ব্লক। সামনেই পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা এবং তার পরই লোকসভা ভোট। এই মুহূতের্র্ ভারতের বিদেশনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে জাতীয় রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এই অবস্থায়, রাশিয়ার মত পুরনো বন্ধুর সঙ্গে বতর্মানের মতপার্থক্যগুলিকে সরিয়ে ইতিবাচক ছবি তুলে ধরাটা ভারতের অগ্রাধিকারের মধ্যেই পড়ে। যে কারণে মনমোহন আজ বৈঠকের পর বলেছেন, “কুড়ানকুলাম পরমাণু শক্তি প্রকল্প আমাদের কৌশলগত মৈত্রীর প্রতীকস্বরূপ। শীঘ্রই ১ নম্বর ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। আগামী বছর দ্বিতীয় ইউনিটটির কাজ শেষ হয়ে যাবে। পুতিনকে জানিয়েছি, তাঁর ২০১০-এর ভারত সফরে যে অসামরিক পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি সই হয়েছিল, তার রূপায়নে আমরা দায়বদ্ধ। অফিসারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সব বকেয়া বিষয় দ্রুত শেষ করতে হবে।”
দু’দেশের সম্পর্ক যাতে শুধু কুড়ানকুলাম-নির্ভর না হয়ে পড়ে সে ব্যাপারেও সচেতন থাকতে চেয়েছে নয়াদিল্লি। দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা, উচ্চপ্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, বিজ্ঞান, প্রতিরক্ষা এবং শিক্ষা নিয়েও সহযোগিতার পথে হেঁটেছে দু’দেশ। মনমোহনের কথায়, “আন্তর্জাতিক আর্থিক মন্দার যুগেও দেখা যাচ্ছে যে ভারত-রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৫% বেড়েছে। তেল ও গ্যাস, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, ওষুধ শিল্প, খনি ও সার ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলিতে সহযোগিতার যথেষ্ট অবকাশ আমরা খতিয়ে দেখেছি।”
এই ক্ষেত্রগুলির মধ্যে প্রতিরক্ষার বিষয়টিতে বেশি জোর দিতে চেয়েছেন মনমোহন। সেই ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় থেকেই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রতি ভারতের নির্ভরতা সুবিদিত। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে স্বনির্ভর বিদেশ নীতিকে আশ্রয় করে আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ভারত। সামরিক চুক্তি হয়েছে ইজরায়েলের সঙ্গে। এ নিয়ে তৈরি অবিশ্বাসের ধোঁয়াশা কাটিয়ে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে এক নতুন অধ্যায় শুরু করার ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সঙ্গে কথা হয়েছে সন্ত্রাসবাদ, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়েও। দু’টি ক্ষেত্রেই ভারতের অবস্থানের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে মস্কো। আফগানিস্তান নিয়ে যৌথ বিবৃতিতে তালিবানের নাম না করে বলা হয়েছে, ‘অস্ত্রধারী বিরোধী শক্তির সঙ্গে শান্তিপ্রক্রিয়া চালানোর ক্ষেত্রে আফগান সরকারের নেতৃত্বে বৈঠককে সমর্থন করে দু’টি দেশই। সেই এই অস্ত্রধারী সংগঠনগুলিকে আর্ন্তজাতিক নিয়মকানুন মানতে হবে। আল কায়দা, অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করতে হবে।’ |