এ রাজ্যে তো বটেই, দেশ জুড়েই গ্রামাঞ্চলে শৌচাগারের অভাব একটা অন্যতম বড় সমস্যা। এক প্রবীণ বাঙালি বিজ্ঞানীর চেষ্টায় এত দিনে এই সমস্যা সমাধানের দরজা খুলতে চলেছে। সুন্দরবন লাগোয়া একটি প্রত্যন্ত গ্রামে সৌরশক্তির প্রয়োগে একটানা জল সংস্থানের ব্যবস্থা করেই স্থানীয় জীবনচর্যায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা শুরু হয়েছে।
এমনিতে এই গ্রহে যত মানুষ খোলা আকাশের নীচে শৌচকাজ সারেন, তার ৫৮ শতাংশই ভারতবাসী। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বারংবার বলেছেন, শৌচাগারের অভাব উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়। যত্র তত্র শৌচকাজের অভ্যাস থেকেই কৃমিজনিত অপুষ্টির চাষ হয় গ্রামীণ ভারতে। মেয়েদের নানা রকমের সংক্রমণের সমস্যা তো আছেই। শৌচালয়ের সমস্যায় স্কুলে যাওয়ার অভ্যাসেও বাধা তৈরি হয়। যোজনা কমিশনের সাম্প্রতিকতম রিপোর্টও বলছে, গ্রামীণ ভারতে ৭৩ শতাংশ বাড়িতেই শৌচাগারের বালাই নেই। আর কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের হিসেবে, গ্রামীণ শৌচালয়গুলির ৭৫ শতাংশই জলের অভাব বা সচেতনতার খামতিতে চালু করা যায়নি। দেবালয় নয়, আগে চাই শৌচালয় জাতীয় রাজনীতিতে এই স্লোগান তুলেছেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশ থেকে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীও। বাঙালি সৌরশক্তিবিশেষজ্ঞ শান্তিপদ গণচৌধুরী সেই স্লোগানকে কাজে পরিণত করে দেখিয়েছেন। |
হাসপাতালে সৌরশক্তি চালিত পাম্পহাউস।—নিজস্ব চিত্র। |
ঘটনার সূত্রপাত বছরখানেক আগে। কুলতলির প্রান্তিক গ্রাম বৈকুণ্ঠপুরের একটি হাসপাতালে সৌর আলোর ব্যবস্থা করতে গিয়েই তাজ্জব বনে যান শান্তিবাবু। তিনি দেখেন, কাছের পুকুর থেকে বালতি-বালতি জল তুলে শৌচকাজে ব্যবহার করছেন রোগীরা। প্রসূতিদেরও দরকারে ভারী বালতি বয়ে আনতে হচ্ছে। এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধানের খোঁজেই শুরু হয় কেন্দ্রীয় সরকারের এনার্জি কমিটির সদস্য তথা রাজ্যের সবুজ শক্তি উন্নয়ন নিগমের অধিকর্তা শান্তিবাবুর গবেষণা। কলকাতার জার্মান কনস্যুলেটের পৃষ্ঠপোষকতায় একটা রাস্তাও দ্রুত বার করে ফেলেন তিনি। পাঁচ লক্ষ টাকায় প্রকল্পটির গবেষণা ও রূপায়ণ সারা হয়েছে। কাল, মঙ্গলবার তা আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু হবে। শান্তিবাবুর দাবি, “যা ব্যবস্থা করেছি, তাতে ওই হাসপাতালে আর জলের অভাব হবে না। এক সঙ্গে শৌচকাজ, পানীয় জল ও আলো জ্বালানোর কাজে সব সময়ে জল মজুত থাকবে।” কুলতলির দু’টি স্কুল ইতিমধ্যেই এই ব্যবস্থা চালু করতে এগিয়ে এসেছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দফতরের সাহায্যে তহবিলও জোগাড় হয়ে গিয়েছে।
ঠিক কী ভাবে স্থায়ী শৌচালয় চালুর পথ বার করেছেন প্রবীণ বিজ্ঞানী? সৌরশক্তির সাহায্যে পাম্প করে জলের ব্যবস্থা হল একটি পদক্ষেপ। আর সৌরশক্তির সুফল কার্যকর করতে তাঁর মোক্ষম চাল, টিভি-র সেটটপ বাক্সের মতো একটি ছোট বৈদ্যুতিন যন্ত্র। নাম তার, ‘ইন্টেলিজেন্ট কন্ট্রোলার’। তাতে ‘সেন্সর’ বসানো। সেন্সরের মাধ্যমে এই যন্ত্রটি টের পায়, কখন পাম্পে জল ভরতে হবে, আবার কখন আলো জ্বালানো কিংবা পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালের ছাদের ট্যাঙ্ক থেকে পাম্পের মাধ্যমে জল সরাসরি যাচ্ছে শৌচাগারের কলে। আর ‘রিভার্স ওসমোসিস’ পদ্ধতিতে জল শোধন করে তা পানীয় জলের সমস্যা মেটাচ্ছে। কখন কোন কাজটা করতে হবে, তা ঠিক করে দিচ্ছে খুদে যন্ত্রই। পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ভাবে এই প্রকল্পের প্রসার ঘটানো যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে আগ্রহী রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। মন্ত্রীর কথায়, “খরচের দিকটা দেখতে হবে। তবে জলের পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে পারলে গ্রামীণ শৌচাগারগুলি আর অকেজো হয়ে পড়ে থাকবে না। তা মানুষের অনেক বেশি কাজে আসবে। সামাজিক অভ্যাসটিও পাল্টে যাবে।” একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রকল্প আধিকারিক কুমার রানার কথায়, “গ্রামে গ্রামে জলের সুবিধা প্রাপ্ত পরিচ্ছন্ন শৌচালয় চালু হলে তা এক বিরাট সামাজিক বদলের রাস্তা খুলে দেবে।” শুধু এ রাজ্যে নয়, শান্তিবাবুর তৈরি যন্ত্র দেশ জুড়েই শৌচাগার সমস্যা মোকাবিলায় পথ দেখাতে পারে বলে মনে করছেন এ দেশে কর্মরত ইউনিসেফ-এর বিশেষজ্ঞরাও।
কিন্তু খারাপ আবহাওয়া বা টানা বৃষ্টিতে কতটা কাজে আসবে সৌরশক্তি নির্ভর এই প্রযুক্তি? শান্তিবাবুর জবাব, “খটখটে রোদে তিনটে পাম্প দু’ঘণ্টা ধরে চালিয়েই পাঁচ হাজারের লিটারের একটি ট্যাঙ্ক ভর্তি করা হচ্ছে। তাহলে অন্তত পাঁচ দিন জলের জোগান নিয়ে চিন্তা নেই।” বর্ষাতেও পাঁচ দিনে একবার ঘণ্টা দুয়েক রোদের দেখা মিলেই থাকে। অর্থাৎ, প্রকৃতির খুব অস্বাভাবিক খেয়াল ছাড়া সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ইউনিসেফ ছাড়াও মেক্সিকো, পেরু, কলাম্বিয়ার মতে তৃতীয় বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশ শান্তিবাবুর দাওয়াইয়ে আগ্রহী। |