|
|
|
|
|
|
|
দু’মুখো বাঙালি |
বাঙালি চির কাল ভিতরে ভিতরে টাকার কাঙাল। অথচ বাইরে বাইরে ভাব দেখাবে: কেয়ার করি না!
চাই লক্ষ্মীর প্রসাদ, এ দিকে মুখে সরস্বতীর গুণগান। লিখছেন নবনীতা দেব সেন। |
হ্যাঁ একটা পাগলা বামুন এসে বলে গেল, টাকা মাটি, মাটি টাকা। অমনি বাঙালি নাকি টাকাকে কাদামাটির মতো পায়ের নীচে মাড়িয়ে চলে যাওয়ার বস্তু ভাবতে শুরু করল। উঁহু, তা কেন, টাকা যে নোংরা জিনিস, সেটা কে না জানে? আমাদের তো ছোটবেলায় দিদিমা হাতে টাকা স্পর্শ করতেই দিতেন না। —‘ছি ছি, ছোটরা ওতে হাত দেয় না, টাকা বড় নোংরা বস্তু, কত হাত ঘুরে আসে, কুষ্ঠরুগির হাতেও যায়! টাকা ছুঁলে হাত ধুতে হয়।’
আর একটু পরে বুঝলুম, যারা টাকা-টাকা করে, তারাও নোংরা জিনিস। ভাল লোকে টাকা ছোঁয় না। টাকা চাওয়াটা লজ্জার ব্যাপার। ছোট-আমি ভাবতুম ভাল লোকের বুঝি টাকার দরকারই হয় না। ভাল ডাক্তারবাবুরা টাকা নেন না। ভাল শিক্ষক অমনি-অমনি পড়িয়ে দেন। আমার বাবা ছোট-বড় অনেক জায়গায় লিখতেন, কোথাও টাকা পেতেন না। মা গাঁইগুঁই করলে বাবা বলতেন, ‘আহা, ওরা যে পারে না!’ বাবাকে তাঁর প্রকাশকেরাও প্রাপ্য টাকা দিতেন না, কোনও বইয়ের ৩৯ সংস্করণ হয়ে যাবার পরেও না। মা চেঁচামেচি করতেন, ‘ওরাও কি পারে না?’ তখন বাবার সলজ্জ উত্তর ছিল, ‘আহা, আমি যে পারি না!’ অর্থাৎ, ন্যায্য পাওনাটা বাবা মুখ ফুটে চাইতে পারেন না। টাকা চাইতে তাঁর মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তানের চক্ষুলজ্জায় বাধে। না কি দেববাড়ির জমিদারি রক্তে বাধে? জমিদারি রক্তের তো পাওনা টাকাকড়ি উসুল করতে বাধো-বাধো লাগার কথাই নয়। বাঙালি জমিদারের বাঙালি নায়েবমশাইরা সে ব্যাপারটা ভালই বুঝতেন। আর প্রকাশক মহোদয়দের আর এক অসুবিধে, অমন পাওনাগন্ডা গুনেগেঁথে মিটিয়ে দিলে কি ব্যবসা চলে? যে লেখক চেঁচামেচি করে, কি কেঁদে-ককিয়ে, চেয়ে-চিন্তে জোগাড় করে নিতে পারেন, তিনি পেয়ে যাবেন! কোনও কোনও লেখক এর কোনওটাই ঠিক পেরে ওঠেন না। তাঁদের কপালে টাকা নেই!
অর্থাৎ, বাঙালির দুটো দিকই সমানেই আছে। এক দলের কাছে টাকার দাম খুব স্পষ্ট, ব্যবসাদারির দিকটাও ঝাড়াঝাপটা, যে নিজের পাওনা বুঝে নিতে অক্ষম, তাকে ঠকিয়ে নিতে অসুবিধে নেই। কী করবে, মা লক্ষ্মী তারই কাছে যান, যে তাঁর মূল্য দেয়। বাঙালির এইখানেই সমস্যা। আমাদের পেটে খিদে, মুখে লাজ। টাকা যে দরকারি বস্তু তাতে সংশয় নেই, এ দিকে টাকা চাইতে সংকোচ, টাকা বড় নোংরা জিনিস। ও দিকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হলেও মন খারাপ হয়, মেজাজ ঠিক থাকে না। এ ক্ষেত্রে আমার মা আর বাবা দুজনে ব্যাপারটা ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন, বাবা চক্ষুলজ্জার আদেশ মেনে চলতে গিয়ে পত্নীর মন রাখতে পারতেন না। আর তখন ওই মেজাজ খারাপ হওয়ার দিকটা মা বেচারির ভাগেই পড়ত। মায়ের বেশ ক্ষোভ ছিল আর আমি ভাবতুম, মা নিজেই বা কেন ওদের বলছেন না ফোন করে? এখন বুঝি, তখনকার বাঙালি ভদ্র সমাজের বিধান ছিল অন্য। স্বামীর ন্যায্য পাওনা উদ্ধারের কথা রাধারানী দেবীর পক্ষে ফোন তুলে প্রকাশককে বলা বঙ্গীয় স্বপ্নের বাইরে! টাকাকড়ি নিয়ে কথা বলাটাই এই সে দিন অবধি বড্ড সংকোচের ছিল মধ্যবিত্ত কেরানি-মাস্টার-সরকারি চাকুরে বাঙালি ভদ্রলোকের সমাজে। আমি ছেলেবেলা থেকে সরস্বতীপুজোর দিনে বাবার মুখে রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতাটি শুনতুম। |
|
সরস্বতীপুজোর দিনে বাবা বইপত্তরের, খাতাকলমের সামনে আসন পেতে বসে ওই কবিতাটি পড়তেন। আমরা বসতুম বাবার আশেপাশে। আর শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ত প্রকাশকদের প্রসঙ্গে মা-বাবার কথোপকথন। কিন্তু কোনও রাজার সভায় বাবা বেচারির তো যাওয়া হয়নি। রাজার গলার মালাও হয়নি পাওয়া। কিন্তু আমার মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছে কিছু উলটোপালটা ভাবনা। ওই কবিতা পড়ে আমিও সরস্বতীপুজো করি। আমার মেয়েরা বসে শোনে।
আমাদের বড় হতে হতে বাংলা আর বাঙালির অনেক বদল হয়েছে। প্রকাশকের কাছে ন্যায্য পাওনাটুকু চাওয়ার মধ্যে আর কোনও সংকোচের জায়গা নেই। প্রকাশক ভাববেন না আপনি অভদ্র, কিংবা গরিব, কিংবা লোভী। তিনি বুঝবেন। তার পরে যা করবার, তাই করবেন। (সেটা অবিশ্যি আপনার মনের মতো না-ও হতে পারে!)
টাকা ব্যাপারটা বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে কালিমাময়, কেবল দু-একটা তুচ্ছ ব্যাপারে ছাড়া! যেমন ধরুন, কন্যেপক্ষের কাছে বরপণ চাইবার বেলাতে। ‘ঘরের লক্ষ্মী’কে ঘরে আনার প্রসঙ্গে তো, লক্ষ্মীশ্রীর ব্যাপার। তার বেলা টাকাকড়ির অংক নিয়ে ‘পষ্ট কথায় কষ্ট নেই!’ যেমন বাঙালি নায়েবদের কোনও অসুবিধে হত না গরিব প্রজাদের মেরেধরে জমিদারের বকেয়া খাজনা আদায় করার চেষ্টায়। তেমনি ভাড়াটে পিটিয়ে ভাড়া আদায়েও বাঙালির লজ্জাশরম দেখা যায়নি! পথে জুলুম করে গাড়ি থামিয়ে পুজোর চাঁদা তোলা, কি বাজার থেকে বাঙালি ছোকরাদের ‘তোলা’ তোলার কথা ছেড়েই দিচ্ছি! আর কাজ আদায়ে ঘুষের প্রসঙ্গটা না হয় অনুচ্চারিতই থাকুক। কে বলেনি, বাঙালি দু’মুখো জাত?
আমরা মুখে এক, আর কাজে আর এক। মুখে যতই বলি না কেন, টাকা মাটি মাটি টাকা, অর্থই অনর্থের মূল, জীবনযাপনের বেলায় তা মনে রাখি কই? আর কেনই বা করব ও সব মনগড়া, লোক-দেখানো, মিথ্যে কথায় বিশ্বাস? কে না জানে টাকা অনেক কিছু এনে দিতে পারে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য, সম্মান, এমনকী না-পড়েই ডিগ্রিও! টাকা থাকলে খুশিমতন দুটি দেওয়া-থোওয়াও যায়! যতই প্রাণে দীনদুঃখীকে দান-ধ্যানের শখ থাকুক, হাটের মধ্যে গামছা পরে হর্ষবর্ধন তো হতে পারেন না আপনি তাই বলে? আর পকেটে টাকাকড়ি থাকলে প্রেম করার সাহসটাও বাড়ে! অথচ মুখে এ সব মানি না আমরা বাঙালিরা। বলি, ব্যবসা? ওরে বাবা, ও সব মাড়ওয়ারি, আর গুজরাতি আর সিন্ধিদের ব্যাপার। আর ছিল বটে অর্থলোলুপ ইংরেজ বণিক। আমরা বাঙালি, আমরা বুদ্ধিজীবী। (অর্থাৎ কলম পিষি। আমরাই আদি ও অকৃত্রিম ‘বাবু’, ব্যবসাদার ইংরেজেরই হাতে তৈরি, ‘শিক্ষিত’ কেরানির জাতি আমরা, ফাইল ঠেলতে শিখেছি, তাই ব্যবসা শেখার সুযোগ পাইনি। আর ‘টাকা করতে’ শিখিনি বলেই অত সহজে আমরা ‘টাকাকে ঘেন্না করি’ বলতে শিখেছি।)
ঘরে টাকা ছিল না, টাকা নেই, তাই আমাদের স্বভাবই হয়েছিল টাকা ব্যাপারটার গুরুত্বকে জীবনে অস্বীকার করা। তার চেয়ে অন্য কিছুকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছি, যেটা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। যেমন, বুদ্ধি, প্রতিভা, সৃষ্টিশীলতা। অথচ বাঙালিও ঠিক জগতের আর সকলের মতনই চিরটা কাল ভিতরে ভিতরে টাকার কাঙাল। বৈশিষ্ট্য কেবল আমরা হচ্ছি নকল। বাইরে বাইরে ভাব দেখাই যেন কেয়ার করি না! অথচ কার বাপের বেতন কত, কার বউ ক’ভরির হার গড়াল, কার ছেলে ক’টা গাড়ি কিনল— এ সব নিয়ে তো আমরা কম মাথা ঘামাই না? আমরা জানি, আমরা লোভী। যার কাছে যা দেখি, সেইটাই চাই আমাদের। আর টাকা-ই তো সব কিছু এনে দিতে পারে! সর্বশক্তি ধরেন দেবী টাকা মায়ী নমোস্তুতে। কিন্তু এত দিন আমরা ছিলুম মুখে এক, আর মনে আর এক। বাঙালি নিজের কাছে নিজে সৎ ছিল না।
দিনকাল পালটেছে। আমরা বাঙালিরাও এখন মনে মনে টাকা করতে চাই, অনেক টাকা, কিন্তু সেটার জন্য খাটতে হবে। শুধু তো শ্রম নয়, ‘ব্যবসাবুদ্ধি’ বলেও একটা খুব জরুরি শক্তি আছে পৃথিবীতে। সেই শক্তিটার জোর না থাকলে মা লক্ষ্মীর কৃপা মেলে না! টাকা করতে বাস্তববুদ্ধি লাগে, দূরদৃষ্টি লাগে, মানবচরিত্রের কূট জ্ঞান লাগে, ইতিহাস-সচেতনতা, রাজনৈতিক জ্ঞানগম্যি, অসীম ধৈর্য, আর কপালজোরও লাগে বইকী। বঙ্গসন্তানের নাকি ব্যবসাবুদ্ধিটায় কমতি আছে, কিন্তু চেষ্টার কমতি নেই ইদানীং। অসৎ পথে টাকা কামানো এখন ফুটপাতের বিরিয়ানির মতো সস্তা, কিন্তু সস্তা বিরিয়ানির মতোই সেই টাকার ধাক্কা হজম করাটাও সহজ হয় না। বাঙালির মধ্যে অসৎ পথে, স্বল্প আয়াসে লক্ষ্মীকে পাকড়ানোর একটু দুর্দম ইচ্ছে ইদানীং দেখা দিয়েছে, চাঁদ সদাগর সেটা দেখলে যারপরনাই লজ্জা পেতেন।
আসলে চাই লক্ষ্মীর প্রসাদ, কিন্তু মুখে সরস্বতীর গুণগান। এই দু’মুখো হয়েই গন্ডগোলটা পাকিয়েছি আমরা। গরিব কবি সরস্বতীর কাছে কেঁদে-ককিয়ে ‘জানো তো মা বাণী সুরের খাদ্যে নরের মেটে না ক্ষুধা’ বললে কী হবে, রাজা যখন ‘যা খুশি নাও’ বললেন, আমাদের নেকু বাঙালি কবি তখন কী চাইলেন? রাজার গলার মালাটি। তা-ও সোনাদানার মালাও যদি হত! বঙ্গমহিলা কবিপত্নীরও এমনই কালচারাল ট্রেনিং, আহ্লাদে আটখানা হয়ে পেটে কিল মেরে ফুলের মালা গলায় শুয়ে পড়লেন। এমন উদ্ভট কাব্যি কেবল বাঙালিই লিখতে পারে, আর বাঙালিই আহ্লাদ করে পড়তে পারে। কেননা, বাঙালি দু’মুখো।
আমরা মনে চাই এক, মুখে বলি অন্য কথা। তার পরে সেটাকেই বিশ্বাস করতে চাই। তখন ভেতর থেকে শেকড় আলগা হতে শুরু করে। এখন বাঙালির পচা স্বপ্নের শেকড় ভুবনায়নের বাতাসে দুলছে।
আমাদের মনের মধ্যে অনেক কিছু নিয়েই লুকোচুরি ছিল। আস্তে আস্তে সেই লুকোচুরির চাদর সরে যাচ্ছে। ‘ইনহিবিশন’গুলো আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে ভুবনায়িত বাঙালির মন থেকে। টাকার ব্যাপারটায় একটা খুব জরুরি আর খুব সেন্ট্রাল ইনহিবিশন ছিল আমাদের। টাকা-করাটা অন্যায়। টাকা আর কালচার পরস্পরবিরোধী শক্তি। টাকা সে-ই করে, যে আনকালচার্ড।
মল-বিলাসী নয়া বাঙালির আর টাকা রোজগারে, টাকা খরচে লজ্জা নেই। ঠিক যেমন খাদ্যে, পানীয়ে, পোশাকে আর সংকোচ নেই গিন্নিদের। বিধবা ঠাকুমার রেস্তরাঁয় বসে নাতির সঙ্গে আমিষ ভক্ষণ (ঘরে এক বিন্দু বিয়ারও চলতে পারে), শুভ্রকেশ বঙ্গীয় গিন্নি মায়েদের বাসে-ট্রেনে-মেট্রোতে পুজোর বাজারের ভিড়ে সালোয়ার-কুর্তা পরে চলাফেরা, কিছু দিন আগেও বঙ্গকল্পনার অতীত ছিল। ওই যে, ইনহিবিশনগুলো একে একে ঘুচে যাচ্ছে? এখন অনায়াসে কলেজের মেয়েরা ছেলেদের বলে, ‘পিরিয়ড হয়েছে, এখন দৌড়োদৌড়ি পারছি না বাপু’! কেজো মায়ের বদলি দিয়ে তরুণ বাঙালি বাবারা বাচ্চাদের চান করাচ্ছেন, পটিতে বসাচ্ছেন, ন্যাপি পালটে দিচ্ছেন। অনায়াসে দুজন পুরুষ, বা দুজন নারী পরস্পরকে ‘পার্টনার’ বলে সমাজে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। বাঙালির এত দিনে লক্ষ্মীশ্রী লাভ হয়েছে অন্তরে অন্তরে।
সারা বিশ্বের নিয়মেই, বঙ্গসংস্কৃতিতেও চির কাল টাকাই ছিল শক্তির উৎস এবং শিল্পসংস্কৃতিরও ‘পৃষ্ঠপোষক’। কাজটা আগে রাজারাজড়ারা করতেন, এখন করেন উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক শিল্পপতিরা, যাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বঙ্গসন্তান নন। তাঁদের উদার সহযোগ সর্বদাই পেয়ে থাকেন বাংলার শিল্প, সাহিত্য, সংগীতচর্চায় উদ্যোগীরা।
আলসে বাঙালি কেরানিবাবু হতে শিখে গিয়ে আর বাণিজ্য করে না, অথচ বাণিজ্যেই বসতে লক্ষ্মী। মা চঞ্চলা বড়, তাঁকে ধরে-বেঁধে ভুলিয়েভালিয়ে পাকড়ে এনে ঝাঁপিতে ভরে ফেলতে হয়। সাবধান, ঝাঁপি খুললেই পালিয়ে যাবেন। বিষধর সর্পের সঙ্গে মা লক্ষ্মীর এইখানে তুলনা চলে। আর সরস্বতী? কোথায় তাঁর বাস? বুকের মধ্যে। সেখানেই থাকুন তিনি, অন্য কোথাও মানায় না তাঁকে। উঠোনে পায়ের ছাপ এঁকে এঁকে পথ চিনিয়ে তাঁকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে হবে না। ফি-হপ্তায় পাঁচালি শুনিয়ে নিজের কর্তব্যকর্ম মনে করিয়ে দিতে হবে না, ‘লক্ষ্মীবার’-এর মতো তাঁর নামে হপ্তার কোনও দিন আমরা উৎসর্গও করিনি। মুখে যতই সরস্বতীর বরপুত্তুর ভাবি না কেন নিজেকে, বাঙালি আসলে মা লক্ষ্মীরই পদতলে আত্মনিবেদিত। বাঙালির লাইফে মা লক্ষ্মীর কোনও ছুটি নেই! নেহাত আমরা জাত-আলসে, তাই বড় করে ব্যবসায় ঢুকতে সাহস পেতুম না, আর যারা সেটা পারে, হিংসে করে তাদের বেনে-টেনে বলে ছ্যা ছ্যা করতুম। এখন ইনহিবিশন ঘুচে গিয়ে আমরা সবাই বেনে আমাদের এই বেনের রাজত্বে! সত্য উদ্ঘাটিত, জাজ্বল্যমান! বাঙালি চিরটা কাল লক্ষ্মীকেই চেয়েছে, লক্ষ্মী ছেলে-তে, লক্ষ্মী মেয়ে-তে, ঘরের লক্ষ্মী ঘরের আনায়, লক্ষ্মীশ্রী-তে, লক্ষ্মীছাড়া-তে, অলক্ষ্মীপনা দূরীকরণে! আমাদের ভাষার মধ্যে বাক্-দেবী কোথায়? আমাদের বাঁচার মধ্যে সরস্বতী কোথায়? কিন্তু ওই যে মনে এক আর মুখে আর এক, এই দ্বিচারণ করেই আমরা এমন একটা কনফিউজ্ড জাতি তৈরি হয়েছি। এই বারে মুক্তি এসেছে, ‘মল’-সভ্যতা সব মল-মালিন্য (চক্ষুলজ্জা) উপড়ে ফেলেছে, অ্যাদ্দিনে বাঙালি চিনেছে বাঙালির গহন গোপন স্বপ্ন, বাঙালির অস্বীকৃত আদর্শ— বেনে হওয়া!
সমস্যা শুধু এই, বাঙালি বড় বুদ্ধিভ্রষ্ট, হতে চাই মা লক্ষ্মীর বরপুত্র, ও দিকে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে সারস্বত চর্চা করে মুখে লক্ষ্মীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, ঘোর ডিনায়াল! এখন? ‘কত গোপন আশা নিয়ে কোন সে গহন রাত্রিশেষে’ আজ এই নব্য ব্যবসায়ের যুগেও যদি বা একটা চেষ্টা চালাই বাণিজ্যে লক্ষ্মী আনয়নের, এত দীর্ঘ অস্বীকারের পরেও আমাদের হৃদ্পদ্মটি প্রস্তুত আছে তো? হবে তো ‘তার ফুটে ওঠা’? না কি, ‘কখন ভেঙে পড়বে বোঁটা’? দুরুদুরু বক্ষে বলি, ‘দ্যাখ রে চেয়ে আপন পানে, পদ্মটি’— প্রস্তুত আছে তো, ‘লক্ষ্মী যখন আসবে’—? কিন্তু এমন দু’মুখো ভক্তিতে কি মা লক্ষ্মী সত্যি সত্যি ঘরে আসেন? হট্টগোলে মা সরস্বতীও হারিয়ে যাবেন না তো? |
ছবি: সুমন চৌধুরী। |
|
|
|
|
|