|
|
|
|
|
|
ল্যাজে পা |
শুভ্রজিৎ দত্ত |
বয়স চল্লিশ। ঠিকানা সুতানুটি। কী বলছিস? আমি কে? আমায় চিনিস না? আশ্চর্য! আমি ‘মিটার’, মিস্টার মিটার। আরে ধ্যার্। ট্যাক্সির মিটার নয়। মিত্তির। এই দ্যাখো। মহা চিত্তির। আমি মিত্র, মিস্টার...ব্যস। আরে নামটা পুরো বলতে দিবি তো? অমনি ‘বাবুমশাই’ জুড়ে দিলি। এই জন্যেই যেখানে সেখানে কথা বলতে চাই না। খালি ফুট কাটবে। আর কাদেরই বা বলব? ওই তো জনতা। মাকাল ফল যত। ল্যাদা ক্যাবলা, আতাক্যালানে। আরে, ‘মিত্র বাবুমশাই’ কেন হতে যাব আমি? কী? ঘোষমশাইয়ের ছড়ায় আছে? হুঁঃ। উনিও লিখেছেন আর তোরাও বুঝে উলটে গেছিস। কী হয়েছে? তোদের ‘আপনি’ করে বলতে হবে? মামদোবাজি! নিচু ক্লাসের লোকেদের ‘তুই’ বলব না? অটোওলা, ট্যাক্সিওলা, সবজিওলা, মুটে, কাজের লোক, আমজনতা এদের আপনি-আজ্ঞে করলে মাথায় উঠে নাচবে না? আবার হল্লা করছিস? ও সব দিন আর নেই। সাম্যবাদ-ফাম্যবাদের সুতো গুটিয়ে গেছে। শ্লা! পলিটিক্স। হাঘরে হাভাতে কিছু মাল, রিফিউজি’র বাচ্চা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এখানকার কিছু বোকাহাঁদা ছোটলোকদের ব্রেনওয়াশ করে, উসকে দিয়ে এ...ই চোপ্!
ফের চেঁচাচ্ছিস? জানিস আমার ঠাকুরদা কে? দেশসেবক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইংরেজদের খুশি করে মিত্র থেকে ‘মিটার’ হয়েছেন। হাসছিস কেন রে? ইংরেজরা না থাকলে কোথায় থাকতে ভাই বাঙালি? যা কিছু ভাল সবই তো ওদের জন্য। আমার ঠাকুরদা সম্পত্তি করেছেন ব্যবসা করে...কী? কী বললি? দালালি করে? মারব না এক...কত নামডাক ছিল জানিস? দুর্ভিক্ষের সময় লঙ্গরখানা খুলেছিলেন জানিস? কত কেষ্টবিষ্টু আমাদের বাড়িতে রাত কাটিয়ে গেছে জানিস? আরে বাবা দেশের সেই টালমাটাল অবস্থায় কলকাতার বুকে এত বড় জমি-বাড়ি হস্তগত করা চাট্টিখানি কথা!
জানিস আমার বাবা কে? নামজাদা সাহিত্যিক (শিশু)। মুচকি হাসি দিচ্ছিস! আরে বাবা, বিখ্যাতরা ব্র্যাকেট দেয়। বাবা কত্ত পুরস্কার পেয়েছেন। রিসেন্টলি তো...কী, নামই শুনিসনি? সে ভাই তোদের দোষ। কী বলছিস? বইপাড়ায় বিক্রিভাল নয়? ছোঃ। ব্লাডি বাঙালি গুণীদের কদর করতে পেরেছে কবে? ‘পারস্পরিক পিঠ চাপড়ানি’ সভার প্রেসিডেন্ট রে বাবা কবে থেকে জানিস?
আমায় দমাতে পারবে না কেউ। আমার লজ্জা নেই। ভয় নেই। ঘেন্না আছে। আমি শ্রেষ্ঠ। আমি সবজান্তা। তোরা কিস্যু জানিস না। সাফল্য, ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি, বুদ্ধিমত্তা, সৌন্দর্য, হামবড়াই ভাব সব আমার ঝুলিতে। কী? আমি ফ্যাসিস্ট? ফ্যাসিস্ট তোর বা...। অ্যাঁ? নার্সিসিস্ট? ফান্ডা দিস না ভাই। এত হিংসে করার কী আছে? নিজেরা হয়ে দেখা না আমার মতো কেউকেটা! সংযম, বিনয়, মূল্যবোধ ও সবের ক্যাঁতায় আগুন। ও সব অক্ষমদের বুলি। আমি আপনাকে ছাড়া শ্লা কাউকে করি না কুর্নিশ। আমি চেঙ্গিজ, আমি হিটলার...। |
|
এই হিট করিস না, ঢিল ছুড়িস না ভাই। আমার সোর্স তোরা জানিস না। জেলে ভরে দেব। আইনের প্যাঁচে ফেলে এমন কিল মারব, উঃ বলার সময় পাবি না। আমি উকিল। ধনেপ্রাণে সারা হয়ে যাবি।
কী? সেন মহাশয় তদারক করে চিঠি না লিখে দিলে নামী উকিলবাবুর জুনিয়র হওয়া হত না? কে বললে এ সব বাজে কথা? একে তেল দিয়ে, ওকে ল্যাং মেরে, তাকে টপকে উঠে আসাটা সেটা কিছু না। তোরা কর না। মুরোদ থাকে তো কর। সাদা বড় গাড়ি আছে মাথায় শুধু লালবাতি লাগানোর অপেক্ষা। ব্যস দেখব তখন কে আটকায়। আরে ভগবানের পরেই আমরা রে। কী বলছিস? আইন ভাঙছিলাম? কালীপুজোর দিন শব্দবিধির তোয়াক্কা না করে মোড়ের মাথায় চকলেট বোম ফাটাচ্ছিলাম। তো? আরে, উকিল বলে কি মানুষ নই? আমার শখ-আহ্লাদ নেই? বেশ করেছি। কী করবি করে নিস যা। জানবি আইনও যেমন আছে, আইনের ফাঁকও তেমন আছে। সব সময় তোদের কাঠি করা স্বভাব। কেন রে? আছি নিজের মতো শান্তিতে। নিজের মতো সংসার করছি। হিসেব-নিকেশ করে মেপে মেপে লাইফটা দাঁড় করাচ্ছি। খালি উলটোপালটা কথা...আর কী বলছিস...ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স? আমি বধূ নির্যা... মারব টেনে এক চড়। আরে কোর্ট আমার ঘরবাড়ি রে! কত নম্বর ধারায় পড়ে জানিস বধূ নির্যাতন? পারবি, পারবি, বউয়ের গায়ে একটা দাগ দেখাতে পারবি? কী যে বলিস? আমি বলে কত ভালবাসি ওকে! কী বলছিস? চাকরি করতে দিই না? বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দিই না? কাজের লোক মনে করি? এই শোন, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলার তোরা কে রে?
প্রেম করে বিয়ে করেছি রে! লাভ ম্যারেজ! রীতিমত এফর্ট দিয়ে। আমাকে পেয়ে বর্তে গেছে রে। ওর কোয়ালিটি আছে নাকি? নেহাত আমি ছিলাম। বাংলা মিডিয়ামের ব্লাডি বোকাহাবা মেয়ে। ঘরসংসার ভাল সামলাতে পারবে। চেহারাটাও মন্দ নয়। ব্যস তুলে নিলাম। স্মার্টনেস আর ফর্সা রং আছে না আমার? সঙ্গে একটু সেন্টু দিলাম। অবাক হচ্ছিস কেন?
নিয়ম করে নন্দনে গেছি। নেকুপুষুমুনু হয়ে অসহায়তার গল্প শুনিয়েছি। বলেছি, দেখার কেউ নেই আমায়। পাত্র হিসেবে আমি খারাপ না। গলে গেল। তার পর রাতে গোপনে ফোন, লাভ লেটার যা যা হয় আর কী চালিয়ে গেছি। সুযোগ বুঝে ফাঁকা বাড়িতে চেখে দেখে ঘরে তুলেছি। ইয়ার্কি? শোন, অনেক করেছি। মেয়েছেলে মেয়েছেলের মতো থাকবে। ঘর-সংসার, বাচ্চাকাচ্চা সামলাবে, শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখবে, রান্না করবে, আমার যত্ন-আত্তি করবে। শনিবার রবিবার ফেসবুক-টুইটার করে ক্লান্ত হলে নিয়ম করে শরীরের খিদে মেটাবে। কী? ওর ইচ্ছে-অনিচ্ছে মানে? আমি স্বামী। ওর সব কিছুর ওপর আমার ‘রাইট’ আছে।
আরে, মেয়েছেলেদের কথায় অত পাত্তা দিতে নেই। সারা সপ্তাহ মামলা করছি। পয়সা রোজগার করছি। সেই পয়সায় খাচ্ছে পরছে। আবার অত মতামত কীসের রে? যেমন বলব তেমন চলবে। কী? আমার কোনও অনুভূতি নেই? নাঃ, সব অনুভূতি শুধু তোদের! সহানুভূতি না থাকলে দিল্লির গণধর্ষণের প্রতিবাদ করতাম না রে ফেসবুকে। নারী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে টুইট করতাম না। আরে বাবা এ সব আন্দোলন-ফান্দোলন তো বাইরের মেয়েরা করবে। ঘরের বউ এ সব করলে সংসার রসাতলে যাবে না? আমাদের কালচারে এ সব চলে না।
কী বলছিস? আমি অমানুষ! যাব্বাবা। এটাই তো ‘লাইফ’! মুরোদ আছে, তাই দাবড়াচ্ছি। টাকা থাকলে সব হয়। বাড়িতে বসে বাঘের দুধ পাওয়া যায়। কী বললি? ব্ল্যাক মানি? ফ্যাচফ্যাচ করিস না তো! এই যে উন্নয়ন উন্নয়ন করে চেঁচাস, কাদের টাকায় হয় এ সব জানিস? তা ছাড়া এত মাথা খাটিয়ে ক্রিমিনালদের বেকসুর খালাস করিয়ে দিই, তার কোনও দাম নেই? আমি তো নিই না, ওরা দেয়, ভালবেসে দেয়। এই যে ঘড়িটা দেখছিস, দাম কত জানিস? দশ হাজার! জীবনে দেখেছিস? শার্ট আর জিন্সটা কত দাম কোনও আইডিয়া আছে? হ্যাহ্যা, ছাড় ছাড়, অজ্ঞান হয়ে যাবি। আরে আমার বগলের ডিয়ো’র জন্য মাসে যা খরচা হয়, তোদের মাস-মাইনে রে! আর খাপ খুলতে আসিস না। কেটে পড়। আজ বিসর্জন। ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিস না? দুগ্গার কাছে কী চাইবি চাইগে যা। ওই তো বলবি সবাই যেন ভাল থাকে মা যা যাঃ।
দুগ্গা মা...মাগো...পুরনো বউটা ছিবড়ে হয়ে গেছে মা। ও যদি চলে যায়, বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে যায় যেন। গেলে, নতুন একটা বউ দিও মা। ফ্রেশ দেখে দিও। ফ্ল্যাবির ওপর ভাল ফিগার। হানিমুন করতে তাইল্যান্ড যাব মাগো। ফ্রায়েড পর্ক, মল্ট হুইস্কি আর নতুন বউ...উস্স্স! মামলা দাও, হিংসা দাও, দিকে দিকে অশান্তি লাগাও মা, আমি চাইব আর তুমি খালি দিয়ে যেও মা। কাম দাও, অর্থ দাও...অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময় না কী সব বলে হ্যাঁ, তাও দিও মা, মাগো। |
|
|
|
|
|