পাঁচ বছরে সাত গুণ!
জ্যান্ত মানুষের কানাকড়িও দাম নেই বলে যেখানে হরবখতই আক্ষেপ শোনা যায় সেখানে তার কঙ্কালের দাম এই হারেই লাফিয়ে বাড়ছে। বছর পাঁচেক আগেও যা মিলত হাজার দু’য়েকে, তা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ হাজারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার-পেট্রোলের দাম বেড়েছে। দাম বেড়েছে সোনা-রুপোরও। পাল্লা দিয়ে দাম বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসেরই। কিন্তু ডলার-পেট্রোলের সঙ্গে তো নরকঙ্কালের কোনও সুদূর সম্পর্কও নেই। তার দাম তা হলে বাড়ছে কেন?
বাড়ার কারণ নতুন তৈরি কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ এবং পুরনো কলেজগুলোতে আসন বৃদ্ধি। গত কয়েক বছরে রাজ্যে এমবিবিএসে আসন সংখ্যা বেড়েছে সব মিলিয়ে প্রায় হাজারখানেক। ডাক্তারির ছাত্র বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেড়েছে কঙ্কালের চাহিদাও।
চাহিদা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু কঙ্কাল কি কম পড়িয়াছে?
রাজ্যে কঙ্কালের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের এক কর্মী। ফোন করে এই প্রশ্ন করতেই তাঁর জবাব, “অভাব কোথায়! দেদার সাপ্লাই। অর্ডার দিলে এক হপ্তার মধ্যেই পেয়ে যাবেন কঙ্কাল।” দাম জানতে চাইলে সাপ্লায়ারের পাল্টা প্রশ্ন, “কোন কলেজ? ক’টা চাই?” নিজেকে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ছাত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে জানাই, “আপনার কলেজে পড়ি। কিন্তু অন্য কলেজের বন্ধুদের জন্যও দরকার।” ওই কর্মী বলেন, “নাম আর রোল নম্বর আমার মোবাইলে এসএমএস করুন। কঙ্কাল রেডি থাকবে। আমাদের কলেজের ছাত্রদের জন্য ১৪ হাজার। অন্য কলেজ হলে দর একটু বেশি।”
সরবরাহ দেদার। তা হলে কঙ্কালের আকাশছোঁয়া দামের কারণটা কী?
সরবরাহকারীদের বক্তব্য, কঙ্কালের অর্থনীতি ঠিক জ্যান্ত মানুষের নিয়মে চলে না। এখানে দাম ঠিক হয় সরবরাহকারীদের মর্জিমতো। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সাধারণ ভাবে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে দান করা মৃতদেহ থেকে কঙ্কাল তৈরি করা হয়। এ ছাড়া হাসপাতালগুলিতে আসা বেওয়ারিশ মৃতদেহ থেকেও কঙ্কাল বার করে নেওয়া হয়। ওই কঙ্কাল মেডিক্যাল পড়ুয়াদের ক্লাসরুমের জন্যই বরাদ্দ। কিন্তু অ্যানাটমি বুঝতে শুধু ক্লাসরুম নয়, হস্টেল বা বাড়িতেও কঙ্কাল প্রয়োজন হয় ছাত্রদের। অথচ তা কেনার কোনও বৈধ ব্যবস্থাই নেই। তাই বহু হাসপাতালের ডোমেরা বেওয়ারিশ মৃতদেহ থেকে কঙ্কাল তৈরি করে পড়ুয়াদের বিক্রি করেন। কঙ্কাল সরবরাহকারীরা জানিয়েছেন, গ্রামের শ্মশানে বহু সময়েই অর্ধদগ্ধ দেহ রেখে ফিরে যান মৃতের আত্মীয়েরা। ওই দেহ থেকেও কঙ্কাল সংগ্রহ করেন শ্মশানের ডোমেরা। এ ছাড়া কবরখানা থেকে কঙ্কাল সরানোর রেওয়াজ তো বহু বছর ধরেই রয়েছে। আইনি ব্যবস্থা না থাকায় গোটা বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে কয়েকটি চক্র। সুযোগ বুঝে তারাই বাজারে কঙ্কালের দর বাড়িয়ে চলেছে।
কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের কথায়, “স্যারেরা বলে দিয়েছেন, নিজেদের কঙ্কাল নিজেরাই জোগাড় করো। কিন্তু পাব কোথায় কঙ্কাল? সিনিয়র দাদাদের ধরছি। তাঁরা অনেকে নিজেদের ব্যবহার করা কঙ্কাল দিতে চাইছেন। কিন্তু তার বিনিময়ে বিপুল দাম চাইছেন। বছর পাঁচেক আগেও দু’তিন হাজার টাকায় কঙ্কাল মিলত। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা।”
একই ছবি অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজেও। সেখানেও মওকা বুঝে ইচ্ছে মতো দামে চুটিয়ে চলছে কঙ্কালের ব্যবসা। চিকিৎসকদের বক্তব্য, কঙ্কাল বাইল্যাটারাল (দু’দিক) এবং ইউনিল্যাটারাল (এক দিক) দু’রকমেরই হয়। যদিও শিক্ষক-চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে এক দিকের কঙ্কালে কাজের কাজ বিশেষ হয় না। মানবদেহকে নির্ভুল ভাবে জানতে গেলে ২০৬টি হাড় সমেত দুটি দিকই যেমন প্রয়োজন, তেমন নারী ও পুরুষ উভয়ের কঙ্কালই পর্যালোচনা করা জরুরি। এসএসকেএমের অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান রীতা রায় বলেন, “আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখন আমরা পুরো সেট-ই কিনতাম। কিন্তু এখন দাম এত বেড়ে গিয়েছে যে পড়ুয়ারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে সেট ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। কেন যে এত দাম বাড়ল সেটাই আমাদের বোধগম্য নয়।”
একই অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন এসএসকেএমের জুনিয়র ডাক্তার শুভজিৎ দত্ত। তিনি বলেন, “চড়া দামের কারণে পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে একটি ইউনিল্যাটারাল কঙ্কাল নিয়েই আট-দশজন পড়ুয়া টানাটানি করছেন।” জেলার এক মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমির শিক্ষক বলেন, “ক্লাস নেওয়ার সময়ে রোজই ছাত্রছাত্রীরা কঙ্কাল পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে। হাসপাতালের ডোমেদের এখন পোয়াবারো। যার যা খুশি দাম হাঁকছে।”
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে কঙ্কালের এই আকাল নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এমন আকাল হওয়ার কথা নয়। প্রচুর মৃতদেহ দান হয় এখন। সেগুলি থেকে কঙ্কাল তৈরি করে পড়ুয়াদের দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তার বিনিময়ে দাম নেওয়ার তো কথা নয়। মওকা বুঝে কিছু লোক কৃত্রিম অভাব তৈরি করে ধান্দা চালাচ্ছে। কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে নিয়ে আমরাও ভাবনাচিন্তা শুরু করেছি।”
স্বাস্থ্যকর্তাদের ‘ভাবনাচিন্তা’ অবশ্য কঙ্কালের দামকে বিন্দুমাত্র নীচে নামাতে পারেনি।
|